১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ১লা ফাল্গুন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |
  • প্রচ্ছদ
  • জাতীয় >> টপ নিউজ >> মতামত
  • কোটা সংস্কার আন্দোলন: সহিংসতা সূত্রপাতের দায় কার?
  • কোটা সংস্কার আন্দোলন: সহিংসতা সূত্রপাতের দায় কার?

    দৈনিক আমার ফেনী

    মো. আবুসালেহ সেকেন্দার

    আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় দীর্ঘদিন থেকেই জামায়াত-শিবিরের অনেক কর্মী-সমর্থকরা তাদের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনে ঢুকে পড়েছে। এই ঢুকে পড়া সবসময় ‘ফাও খাবার লোভে’, ‘উপরি ইনকাম করার জন্য’ অথবা নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা, পদ-পদবি পেতে ঘটেছে তা নয়, এর পিছনে আছে এক গভীর আদর্শিক চক্রান্ত। আওয়ামী লীগকে ভিতর থেকে শেষ করে দেবার ফন্দি।

    সুযোগ বুঝে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় তারা তাদের আসল রূপ প্রকাশ করেছে। ফলে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কোনও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। ওই সব জামায়াত-শিবিরের আদর্শে বিশ্বাসীরা আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগসহ সরকার দলীয় আদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন সংগঠনে ঢুকে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকতার চেতনায় বিশ্বাসীদের কোণঠাসা করে রেখেছে। ফলে তারা চাইলেও সরকার ও দলের এই সংকটকালীন সময়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাই রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলায় সক্রিয় হতে পারেনি।

    কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীদের গণপদত্যাগও জামায়াত-শিবিরের ছকে হয়েছে বলে আমি মনে করি। সংকটকালীন সময়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের গণপদত্যাগের ফলে ছাত্রলীগ ইমেজ সংকটে পড়ে। প্রকৃত নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে দিতেই পরিকল্পিতভাবে এমন গণপদত্যাগের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। যুদ্ধের সময়ে শত্রুপক্ষের মনোবল ভেঙে দিতে এমন কৌশল অবলম্বন করা হয়। প্রথমে শত্রুপক্ষে যোগ দেওয়া হয়। তারপর যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে বা মাঝ পথে শত্রুপক্ষ ত্যাগ করে নিজের পক্ষে ফেরত এলে ওই দলত্যাগ শত্রুপক্ষের সৈন্যদের মনোবল ভেঙে দেয়। এখানেও যুদ্ধের ওই থিওরি ব্যবহার করা হয়েছে। বিগত একযুগ ধরে শিবির ওই ষড়যন্ত্রের প্লট তৈরিতে কৌশলে ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করেছে। পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছে।

    সরকার দলীয় সংগঠন আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলোর জনবিচ্ছিন্নতাও এর জন্য দায়ী। ছাত্রলীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন সাধারণ ছাত্রদের সমস্যা ও সংকট সমাধানে পাশে না দাঁড়িয়ে যৌক্তিক দাবি দাওয়া বাস্তবায়নে আওয়াজ না তুলে সরকারের লাঠিয়াল বাহিনীর ভূমিকা পালন করছে।

    বছরের পর বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে গেস্ট রুম কালচারের নামে সাধারণ ছাত্রদের নির্যাতন করছে। ছাত্রলীগের অনেক নেতাই টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজিতে যুক্ত। ফলে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা দিন দিন কমেছে। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনের সময় তা স্পষ্ট হয়।

    ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের ভিপি পদে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নূরুল হক নূরের কাছে ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি শোভন হেরে যায়। ওই ঘটনার পর ছাত্রলীগের উচিত ছিল নিজেদের আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখা। আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজেদের সংশোধন করা। সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে সম্পর্ক তৈরি করা। কিন্তু তারা তা করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

    উপরন্তু আওয়ামী লীগের একজন মন্ত্রী এবং শীর্ষনেতা ছাত্রলীগকে কোটা সংস্কার আন্দোলন দমনে ‘পেটোয়া বাহিনী’র ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে উসকানি দিয়েছে। সরকারের অত বড় দায়িত্বশীল পদে থেকে এমন বালখিল্য বক্তব্যে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দমনে ‘ছাত্রলীগই যথেষ্ট’ বলে তিনি যে বোঝাতে চেয়েছেন, তার সুযোগ নিয়েছে জামায়াত-শিবিরসহ স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। তার ওই উসকানিতে প্রভাবিত হয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ও তাদের ছত্রছায়ায় অছাত্র টোকাই সন্ত্রাসীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্র ভূমিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর যে হামলা চালিয়েছিল তা ছিল সহিংসতা শুরুর প্রথম ধাপ। তাই উক্ত নেতা ও নেতার আশীর্বাদ পুষ্ট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের বেধড়ক পিটিয়েছিল তারা এই সহিংসতার দায়ভার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।

    তারা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা না করতো তাহলে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির চক্র বাংলাদেশকে রক্তাক্ত ভূমিতে পরিণত করতে পারতো না। সহিংসতা শুরু করার মতলব খুঁজে পেতো না। জামায়াত-শিবির চক্র যে ছক এঁকেছিল সেই ছকেই ছাত্রলীগ পা দিয়েছে।

    ফলে জামায়াত-শিবির চক্র সুযোগ বুঝে সহিংসতাকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দিয়েছে।

    ছাত্রলীগ কর্তৃক সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আরও সরকারবিরোধী হয়ে পড়ে। তারা মানসিকভাবে আহত হয়। অসহায়বোধ করে। তাদের ওই আহত মানসিক অবস্থার সুযোগ নিয়েছে জামায়াত-শিবির চক্র। সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে আরও ধৈর্য ধরতে হতো। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিচক্ষণ হতে হতো। দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে হতো। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিবিরের ষড়যন্ত্রের ছক বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে।

    উমাইয়া শাসক মুয়াবিয়ার একটি উক্তি পৃথিবী বিখ্যাত। তিনি বলেছেন, ‘যেখানে আমার কথায় কাজ হয় সেখানে আমি চাবুক ব্যবহার করি না। আর যেখানে আমার চাবুকে কাজ হয়, সেখানে আমি তরবারি ব্যবহার করি না।’ কোটা সংস্কার আন্দোলনের ক্ষেত্রে লাঠি বা চাপাতি ব্যবহার করার দরকার ছিল না, কথা বললেই সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। সরকারের যে মন্ত্রী ছাত্রলীগকে আন্দোলন দমনে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে মাঠে নামার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি মিডিয়ায় এমন হুমকি-ধমকি না দিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিনিট দশেক কথা বললেই আন্দোলন তার গতি হারাতো।

    সাধারণ শিক্ষার্থীরাও তখন বুঝতো সরকার তাদের দাবির বিষয়ে আন্তরিক। আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্তরিকভাবে কথা বললেও বিষয়টি এত দূর গড়াতো না। অন্তত প্রাণহানির ঘটনা, সহিংসতা এড়ানো যেত।

    বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের জন্য বিরোধী দল বিএনপি ও স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবিরকে দায়ী করেছেন। তার এই দাবি শতভাগ ঠিক। কিন্তু বিএনপি ও স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের বাইরেও সুযোগসন্ধানী আওয়ামী লীগের দুর্নীতিবাজ নেতাকর্মীরা এর জন্য কম দায়ী নয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে কেউ কেউ আলুপোড়া খেতে চেয়েছেন। পুলিশের সাবেক আইজি বেনজির, পিএসসির ড্রাইভার আবুলের মতো দুর্নীতিবাজদের একের পর এক পাকড়াও করার পর তারা আতঙ্কে ছিলেন। যমদূত কখন তাদের পাকড়াও করে সেই ভয়ে তাদের অনেকের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায়। তারাও কেউ কেউ যে এই আন্দোলনে অর্থের জোগান দেয়নি, সেটাও কীভাবে নিশ্চিত হবো?

    কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঘটে যাওয়া প্রাণহানির ঘটনা, সহিংসতা ও ধ্বংসযজ্ঞকে স্রেফ রাজনীতির চোখে দেখলে আওয়ামী লীগ চরম রাজনৈতিক ভুল করবে। বিগত সময়ের মতো একই রেকর্ড বাজিয়ে সব দোষ বিরোধী দলগুলোর ওপর চাপিয়ে বালুতে উটপাখির মতো মুখ বুজে থাকলে এর চরম মূল্য দিতে হবে অচিরেই। কোটা সংস্কার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে কোথায় কোথায় ব্যর্থ ছিল, তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে কি কি ভুল করেছে ভবিষ্যতের জন্য তার খতিয়ান তল্লাশি জরুরি।

    মন্ত্রী ও নেতাদের মুখ বন্ধ রাখার মন্ত্র শেখানো দরকার এখনই। জনবিচ্ছিন্নতার দায় স্বীকার করে জনসংযোগ বাড়াতে হবে। সেনাবাহিনী অথবা পুলিশ নয়, জনগণই ক্ষমতার উৎস এই কথা শুধু মুখে মুখে উচ্চারণ করলে হবে না; জনসংযোগ বাড়িয়ে আওয়ামী লীগকে অচিরেই তা প্রমাণ করতে হবে।

    ইউরোপের অন্যতম রূপবতী শহর হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে অবস্থিত সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন সময়ে একবার একটি বিষয়ে আমার শিক্ষক ও অন্যতম এম.এ থিসিস তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক ড. ম্যাথায়াস রিডেলের কাছে অভিযোগ করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি তোমার নিজের দিকে দেখ। সমস্যার কারণও তুমি, সমাধানও তোমার কাছে আছে।’ তার ওই কথা আমি আজও প্রতিটি ক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলি। কোনও সমস্যা হলে, কোনও সংকটে পড়লে আমি প্রথম নিজের আয়নায় নিজেকে দেখি। সমস্যার কারণ কতটুকু আমি তা বোঝার চেষ্টা করি। নিজের দায় থাকলে ওই ভুল সংশোধন করি।

    আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের উচিত কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে সহিংসতা হয়েছে, প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, সম্পদহানি ঘটেছে তার প্রেক্ষাপট তৈরিতে তাদের দায় উপলব্ধি করা; সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা রাজনৈতিকভাবে কেন তারা মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছে তার সন্ধান করা উচিত এখনই। অন্যথায় জামায়াত-শিবির উইপোকা হয়ে আওয়ামী লীগকে-ছাত্রলীগকে ভিতর থেকে যেভাবে খেয়ে ফেলেছে, জনবিচ্ছিন্ন করেছে তা অচিরেই মেরামত না করা গেলে সেদিন বেশি দূরে নয়, বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী এই রাজনৈতিক দল জনবিচ্ছিন্ন হয়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়বে।

    লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

    আরও পড়ুন

    বিমানের টিকেটের মূল্য কমানোর দাবিতে ফেনীতে মানববন্ধন
    ডিবির অভিযানে এক মাদক কারবারি আটক
    আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের দাবিতে কফিন মিছিল
    আনন্দপুর মাইজগ্রামে দিবা-রাত্রি মিনি ফুটবল বার খেলা উদ্বোধন
    জামেয়া উম্মে সালমা (রা:) কৃতি শিক্ষার্থী সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত
    শিক্ষার্থী নাশিতের আত্মস্বীকৃত খুনিদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন
    ফেনী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে মাদকবিরোধী শ্রেণি বক্তৃতা
    গোবিন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক পুরষ্কার বিতরণ