ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কোরবানি’ অর্থ উৎসর্গ, উপঢৌকন, সান্নিধ্য লাভের উপায়, ত্যাগ করা, পশুত্বকে বিসর্জন ইত্যাদি। হজরত ইবরাহিম (আ.) তার ছেলে হজরত ইসমাইলকে (আ.) আল্লাহর শানে কোরবানি করার উদ্যোগ নেন। সেই থেকে ইসলাম ধর্মে কোরবানি প্রচলন শুরু হয়, এমন ধারণাই বহুল প্রচলিত। তবে ওই ঘটনাই ইসলাম ধর্মে প্রথম কোরবানির ঘটনা নয়। কারণ, ইসলাম ধর্মের প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) এর সময়ও কোরবানির প্রথা প্রচলিত ছিল। আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসির দামেস্কির মতে, আদম তাদের দুজনকে (হাবিল এবং কাবিল) কোরবানি করার আদেশ দিয়ে নিজে হজ করার জন্য মক্কায় চলে যান আদম চলে যাওয়ার পর তারা কোরবানি করেন। হাবিল একটি মোটা তাজা বকরি কোরবানি করেন। তার অনেক বকরি ছিল। আর কাবিল কোরবানি দেন নিজের উৎপাদিত নিম্নমানের এক বোঝা শস্য। তারপর আগুন হাবিলের কোরবানি গ্রাস করে নেয়। আর কাবিলের কোরবানি অগ্রাহ্য করে (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া: ২১৭)।আর ঈদুল আজহার দিন থেকে কুরবানির দিনগুলোতে নির্দিষ্ট প্রকারের গৃহপালিত পশু আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য জবেহ করাই হচ্ছে কুরবানি। ইসলামি শরিয়তে এটি ইবাদত হিসেবে সিদ্ধ। যা কুরআন, হাদিস ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত দ্বারা প্রমাণিত। কুরআন মাজিদে এসেছে-‘তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও কুরবানি কর।’ (সুরা কাউসার : আয়াত ২)
১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত যে প্রাপ্ত বয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন পুরুষ ও নারীর কাছে প্রয়োজনের অতিরিক্ত ৭ ভরি সোনা অথবা সাড়ে ৫২ তোলা রূপার মূল্য পরিমাণ সম্পদ থাকবে তার কুরবানি করা ওয়াজিব।
টাকা-পয়সা, সোনা-রূপার অলঙ্কার, ব্যবসায়িক পণ্য, প্রয়োজনের অতিরিক্ত জমি, সৌখিন বা অপ্রয়োজনী আসবাবপত্র এসব কিছুর মূল্য কুরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য।
কুরবানির শর্তাবলি
কুরবানি করার জন্য নির্দিষ্ট পশু রয়েছে। তবে এ সব পশুর বয়স এবং এক পশুতে কয়জন অংশগ্রহণ করতে পারবে এ সম্পর্কে ইসলামের অনেক দিকনির্দেশনা রয়েছে। আর তাহলো-
> কুরবানির পশু
এমন পশু দ্বারা কুরবানি দিতে হবে যা ইসলামি শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে। সেগুলো হল- উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। এগুলোকে কুরআনের ভাষায় বলা হয় ‘বাহীমাতুল আনআম।’ হাদিসে এসেছে- ‘তোমরা অবশ্যই নির্দিষ্ট বয়সের পশু কুরবানি করবে। তবে তা তোমাদের জন্য দুষ্কর হলে ছয় মাসের মেষ-শাবক কুরবানি করতে পার।’
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা ছাড়া অন্য কোনো জন্তু কুরবানি করেননি ও কুরবানি করতে বলেননি। তাই কুরবানি শুধু এগুলো দিয়েই করতে হবে।
ইমাম মালিক রাহমাতুল্লাহি আলাইহি’র মতে, কুরবানির জন্য সর্বোত্তম জন্তু হল শিংওয়ালা সাদা-কালো দুম্বা। কারণ রাসলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ ধরনের দুম্বা কুরবানি করেছেন বলে বুখারি ও মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে।
উট, গরু ও মহিষ সাত ভাগে কুরবানি দেয়া যায়। হাদিসে এসেছে- ‘আমরা হুদাইবিয়াতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ছিলাম। তখন আমরা উট ও গরু দ্বারা সাত জনের পক্ষ থেকে কুরবানি দিয়েছি।’
গুণগত দিক থেকে উত্তম হল- কুরবানির পশু হৃষ্টপুষ্ট, অধিক গোশত সম্পন্ন, নিখুঁত, দেখতে সুন্দর হওয়া।
> কুরবানির পশুর বয়স
কুরবানির পশু পরিপূর্ণ বয়সের হতে হবে। ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে কুরবানির পশুর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখা জরুরি। আর তাহলো-
– উট : পাঁচ বছরের হতে হবে।
– গরু-মহিষ : দুই বছরের হতে হবে।
– ছাগল-ভেড়া-দুম্বা : এক বছর বয়সের হতে হবে।
> পশু দোষ-ত্রুটিমুক্ত হতে হবে
কুরবানির পশু যাবতীয় দোষ-ত্রুটিমুক্ত হতে হবে। হাদিসে এসেছে-
সাহাবি হজরত আল-বারা ইবনে আজেব রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন তারপর বললেন- চার ধরনের পশু, যা দিয়ে কুরবানি জায়েজ হবে না। অন্য বর্ণনায় বলা হয়েছে পরিপূর্ণ হবে না। (আর তাহলো)-
– অন্ধ, যার অন্ধত্ব স্পষ্ট।
– রোগাক্রান্ত, যার রোগ স্পষ্ট।
– পঙ্গু, যার পঙ্গুত্ব স্পষ্ট এবং
– আহত, যার কোনো অঙ্গ ভেঙ্গে গেছে। নাসাঈ’র বর্ণনা ‘আহত’ শব্দের স্থলে ‘পাগল’ উল্লেখ আছে।
> কুরবানি মাকরূহ হবে
আবার পশুর এমন কতগুলো ত্রুটি আছে যা থাকলে কুরবানি আদায় হবে কিন্তু তা মাকরূহ হবে। এ সব দোষত্রুটিযুক্ত পশু কুরবানি না করাই ভালো। আর তাহলো-
– পশুর শিং ভাঙ্গা।
– কান কাটা।
– লেজ কাটা।
– ওলান কাটা কিংবা লিঙ্গ কাটা ইত্যাদি।
> পরিপূর্ণ মালিকানা থাকা
কুরবানি দাতা যে পশুটি কুরবানি করবেন, তার উপর কুরবানি দাতার পরিপূর্ণ মালিকানাসত্ত্ব থাকতে হবে। যদি এ পশু বন্ধকের পশু, কর্জ করা পশু বা পথে পাওয়া পশু হয় তবে তা দ্বারা কুরবানি আদায় হবে না।
কুরবানির নিয়মাবলী
> মুখের উচ্চারণ দ্বারা নির্দিষ্ট করা যেতে পারে। এভাবে বলা যায় যে- ‘এ পশুটি আমার কুরবানির জন্য নির্দিষ্ট করা হল।’ তবে ভবিষ্যতের জন্য নির্দিষ্ট করা যাবে না। এমন বলা যে- ‘আমি এ পশুটি কুরবানির জন্য রেখে দেব।’
> কাজের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা যায়। যেমন- কুরবানির নিয়তে পশু কেনা অথবা কুরবানির নিয়তে জবেহ করা। যখন পশু কুরবানির জন্য নির্দিষ্ট করা হয় তখন কিছু বিষয় কার্যকর হয়ে যায়। আর তাহলো-
– প্রথমত : এ পশু কুরবানি ছাড়া অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না। দান করা যাবে না। বিক্রি করা যাবে না। তবে কুরবানি ভালোভাবে আদায় করার জন্য তার চেয়ে উত্তম পশু দ্বারা পরিবর্তন করা যাবে।
– দ্বিতীয়ত : যদি পশুর মালিক মারা যায় তবে তার ওয়ারিশদের দায়িত্ব হল এ কুরবানি বাস্তবায়ন করা।
– তৃতীয়ত : এ পশুর থেকে কোনো ধরনের উপকার ভোগ করা যাবে না। যেমন- কুরবানির পশুর দুধ বিক্রি করা যাবে না। কৃষিকাজে ব্যবহার করা যাবে না। সাওয়ারি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। পশম বিক্রি করা যাবে না। যদি পশম আলাদা করে তাবে তা সদকা করে দিতে হবে বা নিজের কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারবে কিন্তু বিক্রি করা যাবে না।
– চতুর্থত : কুরবানি দাতার অবহেলা বা অযত্নের কারণে যদি কুরবানির নির্ধারিত পশুটি দোষযুক্ত হয়ে পড়ে, চুরি হয়ে যায় কিংবা হারিয়ে যায় তবে কুরবানি দাতার কর্তব্য হবে অনুরূপ বা তার চেয়ে ভাল একটি পশু ক্রয় করা। আর যদি অবহেলা বা অযত্নের কারণে না হয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে দোষযুক্ত হয় তবে এ দোষযুক্ত পশু কুরবানি করা যাবে।
– যদি পশুটি হারিয়ে যায় অথবা চুরি হয়ে যায় আর কুরবানি দাতার উপর আগে থেকেই কুরবানি ওয়াজিব হয়ে থাকে তাহলে সে কুরবানির দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভ করবে।
– আর যদি আগে থেকে কুরবানি ওয়াজিব ছিল না কিন্তু সে কুরবানির নিয়তে পশু ক্রয় করে থাকে তবে চুরি হয়ে গেলে বা মরে গেলে অথবা হারিয়ে গেলে তাকে আবার পশু কিনে কুরবানি করতে হবে।
পরিশেষে বলতে চাই, কুরবানির মাধ্যমে আল্লাহ মানুষের রিযিকে ও প্রাকৃতিক সম্পদে বরকত দান করেন। সকল কিছুর মধ্যেই আল্লাহর হিকমত ও প্রজ্ঞা লুকায়িত। মানুষের অনুধাবন-ক্ষমতা খুবই কম। এজন্যই বিনা-প্রশ্নে আল্লাহ আদেশ-নিষেধ পালন করে যাওয়াই হল একজন মুমিনের একমাত্র কর্তব্য।হে আল্লাহ! মুসলিম উম্মাহকে যথাযথ শর্ত ও নিয়ম মেনে কুরবানির পশু কেনার ও কুরবানি করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক,কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।