বিশেষ প্রতিনিধি
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতা-কর্মী লাপাত্তা। এ কাতারে রয়েছে জেলার তিনটি আসনের সাবেক এমপি, সকল উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র ও প্রায় সব ইউপি চেয়ারম্যান। পৌরসভার কাউন্সিলর ও ইউপি সদস্যরাও দিয়েছে গা ঢাকা।
জেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কিছু নেতা কর্মী গ্রেপ্তার করা হলেও বিভিন্ন অপকর্মের হোতা, অমকর্মের সহযোগীরা রয়েছে লাপাত্তা। যাদের দাপটে দলের ত্যাগী ও প্রবীন নেতারা একসময় তটস্থ থাকতেন তারা নিজেরা এখন গা ঢাকা দিয়েছেন। প্রবীন ও ত্যাগী নেতারা বলছেন, নৌকা ডুবিয়ে হাইব্রিড নেতারা গা ঢাকা দিয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছিুক আওয়ামী লীগ দলীয় নেতাদের অভিযোগ, যারা বালুমহাল, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, বাসস্ট্যান্ড, সিএনজি স্ট্যান্ড, শালিস বাণিজ্য, ব্যবসায়ী সংগঠনে ব্যানারে বাণিজ্য, দখল বাণিজ্য, মাদক কারবারি নিয়ন্ত্রণ করতেন ও কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করতেন তাঁরা দলের বিপদ দেখে সটকে পড়েছেন। অথচ সাত মাস আগেও রাজনীতিতে ছিল তাদের একচেটিয়া দাপট। তাদের কথার বাহিরে কারো কোন কিছু বলার সাহস পর্যন্ত ছিলো না। তারা টাকা কামাই করে বিদেশের মাটিতে গিয়ে পিকনিক মুডে আছেন। দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা তার প্রায়শ্চিত্ত দিচ্ছেন। দলের লাখকর্মী গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। তাদের হাতে কোন টাক-পয়সা নেই। তারা মানবেতর জীবযাপন করছেন। দল ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ও যারা দলীয় নেতাকর্মীদের হাতে নির্যাতিত ছিলেন, তারা এখনও মানবেতর জীবন যাপন করছে। দলীয় নেতাকর্মীরা জানান, যুবলীগ, ছাত্রলীগের অনেক নেতাকর্মী এখন ঢাকা-চট্টগামসহ বিভিন্ন শহরে রিকশা ও টমটম চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। পরিবারের সাথে দেখা করতে পারছেন না। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাদের অভিযোগ শীর্ষ নেতাদের পাপের ফল তারা ভোগ করছে। শীর্ষ নেতারা যদি অপকর্ম না করতেন তাহলে হয়তো তাদের এ বিপদে পড়তে হতো না।
ছাত্রদের ব্যানারে টানা ৩৬ দিনের আন্দোলনে ৫ আগস্ট ২০২৪ আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। আওয়ামী সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠন- যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, তাঁতী লীগ, মৎস্যজীবী লীগ, যুব মহিলা লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ছাড়াও শতাধিক সংগঠনের আতœপ্রকাশ হয়। দলীয় শীর্ষ পর্যায় থেকে তাদের বিরুদ্ধে বারবার বলার পরও কোন সংগঠনতো বন্ধ হয়নি উল্টো নতুন নতুন সংগঠনের আতœপ্রকাশ করে সুবিধাভোগীরা। আওয়ামী লীগ পতনের পর তাদের সবাই দিয়েছেন গা ঢাকা।
এসব সুবিধাভোগী সংগঠনের পাশাপাশি মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগের নেতৃবৃন্দও এসময় ধরাকে সরা জ্ঞান মনে করতো। ফুলগাজী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান একরামের খুনি আবিদের মা বড় মনিও হয়ে উঠে রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। হঠাৎ করে ফেনীর রাজনীতিতে এসে তিনি অল্প কয়েক বছরের ব্যবধানে হয়ে যান জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান। তাকেও তার চামচারা ‘মা’ বলে সম্বোধন করে পোস্ট দেয়া শুরু করে। কারণ তিনি এমপি নিজাম হাজারীর সম্পর্কে মামী হন।
ক্ষমতায় থাকাকালীন যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতারা বিভিন্ন অফিসে প্রভাব দেখিয়েছেন। তাদের তদবির, টেন্ডারে ভাগ দেওয়া নিয়ে অতিষ্ঠ ছিলেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা। কোন একটা প্রকল্প আসার অনেক আগেই ঠিকাদারী কাজ হয়ে যেত বিক্রি। জেলার কয়েকজন ঠিকাদার কাজ পাওয়ার আশায় শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে অগ্রীম কোটি টাকা দিয়ে এখন নিজে ফকির হয়ে গেছেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে এই নেতা-নেত্রীরা এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন যে তারা নানা অপকর্ম করলেও তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সুযোগ ছিলো না। তবে ফেনীতে অন্যায়কারী প্রভাবশালী বিরুদ্ধ নিউজ করে মিডিয়াকে তেমন সমস্যায় পড়তে হয়নি।
বিভিন্ন মাধ্যমে জানা গেছে, ফেনী থেকে লাপাত্তা হওয়া এসব নেতাকর্মীদের বেশির ভাগ বর্তমানে ভারতে অবস্থান করছেন। সৌদি আরব ও ডুবাইতে রয়েছেন কয়েকজন শীর্ষ নেতা। ইউরোপ ও আমেরিকায় পাড়ি জমিয়েছেন কয়েক নেতা ও জনপ্রতিনিধি। যারা দল করে তেমন কোন সুবিধা আদায় করেননি তারা দেশের বিভিন্ন জেলায় আতœগোপনে আছেন। অনেকে মামলার ভয়ে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করছেন। আতœগোপনে থাকা নেতা-কর্মীদের সাথে আলাপকালে তারা জানান, তারা কোন অপরাধ করেনি, চাঁদাবাজী করেনি, অন্যের হক নষ্ট করেনি, কারো কানো ক্ষতি করেনি। দলের পদ-পদবী থাকায় তার বিপদে পড়েছেন। দল করা অন্যায় নয়। যত দিন বেঁচে থাকবো দল করে যাবেন বলেও তারা জাজান। যারা আওয়ামী লীগের সামান্য কর্মী ও সমর্থক তাদেরও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। আমরাও বাড়িতে থাকলে মামলা ও হামলার শিকার হতে পারি সেজন্য প্রতিপক্ষের চোখের আড়ালে রয়েছি বলে মন্তব্য করেন নেতাকর্মীরা।
ফেনী পৌর আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, একাডেমির গরু কামাল, মধুপুরের বাদলদের মতো লোককে কেন কাউন্সিলর বানাতে হবে। এতে কি দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে না বৃদ্ধি পয়েছে এ প্রশ্ন রাখছি শীর্ষ নেতাদের কাছে? দলের আরেক নিবেদিত কর্মী বলেন, ধলিয়ার মুন্সির কাছে এমন কি আছে তাকে চেয়ারম্যান বানাতে হবে? দলীয় নেতকর্মীরা বলেন, অশিক্ষিত, অর্ধ শিক্ষিত, মুর্খ, চাঁদাবাজ, ডিগবাজী দেয়া নেতা ও সন্ত্রাসীদের জনপ্রতিনিধি বানানো হয়েছে। তার ব্যর্থ হওয়ার পরও বারাবার তাদের একক প্রাথী হিসেবে দল থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে দলীয় মনোনয়ন দিতে মানা করার পরও দল থেকে অযোগ্যদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। তারা নির্বাচিত হয়ে যে যার মতো বাণিজ্য ও লুটপাট করেছেন। এ কারনে দলের নেতৃবৃন্দের সাথে তৃণমূলের কোন সম্পর্ক ছিলো না। হাইব্রিডরা নৌকাকে ডুবিয়ে নিজেরা লাপাত্তা হয়েছেন। তারা জানান, শীর্ষ নেতা, আঞ্চলিক নেতা, পাড়ার নেতাসহ সব নেতা ও জনপ্রতিনিধি সে যে লাপাত্তা হয়েছে তারপর থেকে তাদের আর কোন যোগাযোগ নেই।
আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে চাইলে তারা সবাই এব্যাপারে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।