জমির বেগ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবর প্রচার হওয়ার পরপর দেশের বিভিন্ন জেলার মতো ফেনীতেও হয়েছে অগ্নি সন্ত্রাস, লুটপাট ও ভাঙচুরের মতো ঘটনা। ফেনীতে আওয়ামী লীগের সাংসদ, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও আওয়ামী লীগের কার্যালয় ছাড়াও ভাঙচুর অগ্নি সংযোগ এবং লুটপাট করা হয়েছে ফেনী পৌরসভা, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ডায়াবেটিস হাসপাতালসহ বিভিন্ন থানায়। লুটপাট ও ভাঙচুুর করা হয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে।
এদিকে আমজনতা সরকারি প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের ঘটনাটি স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি। সরকারি স্থাপনাসহ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের গণঅভ্যুত্থানকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, সরকার পতনের পর আনন্দ মিছিল করা যেতো, মিষ্টিমুখ করা যেত। যেভাবে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে তা কিছুতেই কাম্য নয়। যারা ধবংসাতœক রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলো না তাদের উপর আক্রমনও কাম্য নয়। এর দায় কিছুতেই এড়াতে পারে না সাধারণ ছাত্র ও আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত রাজনৈতিক দলগুলোকে। তারা জানান, সরকারি এসব প্রতিষ্ঠান কোন ব্যক্তি বা দলের নয়। এগুলো রাষ্ট্রীয় সম্পদ। রাষ্ট্রীয় সম্পদ এভাবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে অঙ্গার করে দিয়ে তার নিজেদের ঠকিয়েছে। এর খেসারত তাদের ও ফেনীবাসীকেই দিতে হবে। কয়েকজন ঠিকাদার জানান, পৌরসভায় আগুন দেয়ার কারনে তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তারা পৌরসভায় অনেক বছর ঠিকাদারী করেন। আগুনে কম্পিউটারসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পুড়ে যাওয়ায় তারা কিভাবে তাদের বিল পাবেন? তারা বলেন আমাদের রাতের ঘুম হারাম হয়েগেছে। যদি প্রয়োজনীয় ডুকুমেন্টস পাওয়া না যায় তাহলে তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে রাস্তায় বসতে হবে। এক ঠিকাদার জানান, তার ৭ বছর আগের কয়েকটি ফাইলের প্রায় ৫০ লাখ টাকা পৌরসভার কাছে পাওনা আছে। কিভাবে সে টাকা পাবে সে চিন্তায় সে পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
এদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ফেনী পৌরসভার ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করা হয়েছে। তালিকা অনুযায়ি ফেনী পৌরসভায় গত ৫ আগস্ট অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনায় ২৫টি খাতে ৫ কোটি ৫৬ লাখ ৮৬ হাজার ৭৫০ টাকার মালামালের ক্ষতি হয়েছে।
ফেনী পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মো. আবুজর গিফারী বলেন, ৫ আগস্ট সহিংসতায় পৌরসভার ২৫ খাতে নিরূপিত ক্ষতি মূল্যায়ন করে আনুমানিক আর্থিক পরিমাণ সাড়ে ৫ কোটি টাকার বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রাপ্ত ক্ষয়ক্ষতির তালিকায় দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে যান্ত্রিক শাখায়। এই শাখায় ২ কোটি ৯৩ লাখ ৩০ হাজার টাকার যানবাহন ও বিভিন্ন সামগ্রীর ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া পৌর নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা, মেডিকেল অফিসারের কক্ষে ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ৬০০, সাধারণ শাখায় ৫১ লাখ ৩ হাজার ও হিসাব বিভাগ শাখায় ক্ষতি হয়েছে ৯ লাখ ৮৯ হাজার টাকার মালামাল।
পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন জানান, দুর্বৃত্তরা পৌরসভার মৃতদেহ ফ্রিজিং করার অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত পুড়ে ফেলেছ। লাশ ফ্রিজিং করার গাড়িটি পুড়ে ফেলায় ফেনীবাসী মৃতদেহ দীর্ঘক্ষন ধরে রাখার যে সুবিধা পেত সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের জামাল উদ্দিন জানান, পৌরসভার বিভিন্ন গাড়ি পুড়ে দেয়ায় পৌরবাসী বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শহরের কোন ছেলে এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারে তা বিশ্বাস হচ্ছে না।
জানাগেছে পৌরসভার আগুনে কর নিরূপণ শাখায় মালামাল ক্ষতি হয়েছে ৩ লাখ ১২ হাজার ৮৩০ টাকার, কর আদায় শাখার ১৫ লাখ ৬৩ হাজার, ট্রেড লাইসেন্স শাখার ৬ লাখ ৯৮ হাজার ১০০, স্বাস্থ্য শাখায় ২ লাখ ৯১ হাজার, কনজারভেন্সি শাখার ২৯ লাখ ৫৭ হাজার, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কক্ষের ৭ লাখ ২৮ হাজার ৫০০, উপসহকারী প্রকৌশলী সিভিল-১ কক্ষের ২ লাখ ৩৩ হাজার, উপসহকারী প্রকৌশলী সিভিল-২ কক্ষের ৩ লাখ ৯৭ হাজার, উচ্চমান সহকারীর কক্ষের ২ লাখ ৮ হাজার, উপসহকারী প্রকৌশলীর (বিদ্যুৎ) ৪ লাখ ৩ হাজার টাকা, উপসহকারী প্রকৌশলীর (বিদ্যুৎ) কক্ষের ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ টাকার বৈদ্যুতিক মালামালের ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়া ব্লাড ব্যাংকে ৩ লাখ ৯৪ হাজার টাকার মালামাল ক্ষতি হয়েছে, মশকনিধন কক্ষে ১৭ লাখ ৪৩ হাজার, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ৩ লাখ ৯০ হাজার ৯০০, মসজিদে ২ লাখ ২২ হাজার ৬২০, রিকশা স্টোরের ৪ লাখ ৫৮ হাজার ৬০০, পানি শাখার ৭ লাখ ৪৩ হাজার ৫০০ এবং পেট্রোবাংলার পানি শাখার ৪ লাখ ৬৫ হাজার টাকার মালামালের ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া আগুনে পৌর ভবনের আনুমানিক ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০ লাখ টাকা।
স্থানীয় সরকার ফেনীর উপপরিচালক (ডিডিএলজি) গোলাম মোহাম্মদ বাতেন বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার আলোকে ক্ষতি নিরূপণের তালিকা করা হয়েছে। এটি সংস্কারে পৌরসভার রাজস্ব তহবিল থেকে কিছু ব্যয় হতে পারে। এ ক্ষেত্রে পৌর পরিষদকে এটি করতে হবে। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে বরাদ্দ চেয়ে চিঠি পাঠানো হবে।’
অগ্নিসংযোগ, হামলা ও লুটপাটে বিএনপি কিংবা জামায়াতের লোক নেই বলে দাবি করেছেন দল দুটির শীর্ষ নেতারা। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক শেখ ফরিদ বাহার বলেন, ‘বিএনপির কোনো নেতা-কর্মী এসব অপকর্মে জড়িত নয়। টোকাই শ্রেণির কিছু লোক ফেনী পৌরসভা, ফেনী মডেল থানাসহ সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এসব স্থাপনায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে। আমরা পাহারা দিয়েছি। ৫ আগস্ট পুরো রাত ফেনী বাজার পাহারা দিয়েছে আমাদের সংগঠনের নেতাকর্মীরা। থানাসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় আমরা পাহাড়া দিয়েছি। পুজা মন্ডমসহ উপসনালয়গুলোতেও পাহাড়া দিয়েছে আমাদের নেতাকর্মীরা।
জেলা জামায়াতের আমির এ কে এম শামসুদ্দিন জানান, যারা এসব স্থাপনায় আগুন দিয়েছে তারা রাষ্ট্রের শত্রু। কোন বিবেকবান লোক এসব কাজি জড়িত থাকতে পারে না। জামায়াত ও বিএনপি কেউ এসব কাজে জড়িত ছিলো না। কিছু ছেঁছড়া ও টোকাই এসব কাজে জড়িত ছিলো। যারা আগুন দিয়েছে তাদের কাউকেই আমরা চিনিও না। সরকারি স্থাপনায় আগুন দেয়া হবে এমন সংবাদ পেয়ে আমরা বিএনপিকে নিয়ে জেলা কারাগার, পুলিশ লাইন, ডায়াবেটিস হাসপাতাল, বিভিন্ন থানায় পাহারা বসিয়েছি। তারপরও কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটে গেছে। ৫ আগস্ট থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত আমাদের সংগঠনের নেতা কর্মীরা পালাক্রমে পুলিশ লাইনসহ বিভিন্ন থানায় পাহারা বসিয়েছি। বিভিন্ন থানায় আমরা কম্পিউটার দিয়েছি, কাজ চালিয়ে নেয়ার জন্য।
প্রসঙ্গত; গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরে পরপর বিক্ষুব্ধ জনতার একটি অংশ ফেনী পৌরসভা, ফেনী মডেল থানাসহ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধিদের বাড়ি ঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সাধারণ মানুষের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নি সন্ত্রাসে জেিড়য় পড়ে। এরপর কয়েকদিন বন্ধ হয়ে যায়, পৌরসভা ও থান থেকে নাগরিক সেবা।