আবু ইউসুফ মিন্টু
অবৈধ টেন্ডার বাণিজ্য, মাদক ব্যবসা, নারী কেলেংকারী, দখল বাণিজ্যসহ বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া গেছে পরশুরাম পৌর সভার কর আদায়কারি একেএম মহিবুল হাসান আরিপের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জনকে টাকার জন্য তুলে নিয়ে মারধর করাসহ রয়েছে নানা অপরাধের অভিযোগ। পৌরসভার সামান্য কর্মচারী হয়েও সে গড়ে তুলেছে সম্পদের পাহাড়। ফেনী ও পরশুরামে তার নামে ৫টি বাড়ি, ৩টি হাইস, এ্যাম্বুলেন্স, ফার্মেসী, ক্লিনিক ছাড়াও কোটি কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে বলে জানাগেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে গত পনের বছরের অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় বানিয়েছেন তিনি। তার হাতে জিম্মি গোটা পরশুরাম পৌর এলাকার সর্বসাধারণ।
একেএম মহিবুল হাসান আরিপ পরশুরামের মির্জানগর ইউনিয়নের মৃত আবুল বশরের ছেলে।
জানাগেছে, গত পনের বছর ধরে একটানা পরশুরাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রোগীদের খাদ্য সরবরাহের লাইসেন্স ছিলো আরিপের নিয়ন্ত্রণে। নিহাল এন্টার প্রাইজের নামে তিনি হাসপাতালে খাদ্য সরবরাহ করতেন। হাসপাতালে অসুস্থ্য ভর্তিকৃত রোগীদের খাবার সরবরাহে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা।
পরশুরাম পৌরসভার কর্মচারি হয়েও অন্য ঠিকাদারদের লাইসেন্স বাতিল করে আওয়ামী লীগ নেতা নজরুল ইসলাম রিটুর মালিকানাধীন সুফিয়া এন্টারপ্রাইজের নামে বেআইনি অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ উপায় ঠিকাদারি কাজ করতেন তিনি। নি¤œমানে কাজ করে কয়েক কোটি টাকা অবৈধ উপার্জনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠজন হয়ে ২০ হাজার টাকা বেতনের এই কর্মচারি বর্তমানে অর্ধশত কোটি টাকার মালিক।
জানাগেছে, গণঅভ্যুত্থানের দিন বিকেলে উপজেলার বক্সমাহমুদ ইউনিয়নের কেতরাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালায় আরিপ। তার হাতে গত পনের বছরে পৌরসভার প্রকৌশলী, স্টাফসহ শতাধিকজন মারধরের শিকার হয়েছেন। এছাড়াও বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মীকে মারধর ও মামলা হামলা করে সর্বশান্ত করে দিয়েছে আরিপ। শুধু তাই নয় পৌরসভার কাউন্সিলরসহ তখনকার একাধিক সরকার দলীয় নেতাকর্মীরাও তার হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত হয়েছে।
ফেনী শহরের জেলা পরিষদ সংলগ্ন বিলাস বহুল অ্যাপার্টমেন্ট শর্শদি হাউজে রয়েছে তার প্রায় কোটি টাকা দামের ফ্লাট। ওই ফ্লাটের শহিদুল্লাহ সহ কর্মচারিরা জানান, গত ছয়মাসে ইন্টরিয়ার ডিজাইনসহ বিদেশী ফার্নিচার সাজ সজ্জায় আরিপ ব্যয় করেছে আরো এক কোটি টাকার মতো। এছাড়াও পরশুরাম কলেজ রোডস্থ রেলনাইনের পাশে প্রায় অর্ধকোটি টাকার জমি ক্রয় করে বানিয়েছেন বিলাসবহুল বাড়ি। সেই বাড়িতে থাকেন তার স্ত্রী, সন্তান ও ছোট ভাই মেহেদীর পরিবার। পল্লী বিদ্যুৎ অফিস সংলগ্ন রেললাইনের পাশে রয়েছে তার প্রায় বিশ শতাংশ জমি। যার দাম প্রায় কোটি টাকা। ছয়ঘরিয়া রয়েছে কোটি টাকার জমি।
আরিপ দুধর্ষ ও ভয়ংক সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ছাড়াও বিশেষ গাড়ি ব্যবহার করে বছরের পর বছর চালিয়েছেন মাদক ব্যবসা। থ্রী-স্টার গ্রুপের সদস্যদের দিয়ে মারধর ও জিম্মি করে একে একে হাতিয়ে নিয়েছেন মানুষের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, জায়গা জমি। শুধু তাই নয় লোকজনকে তুলে নিয়ে মামলার ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা।
পরশুরাম পৌরসভার কয়েক জন কাউন্সিলর নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তারা তার কাছে অসহায় ছিলেন। রাজনৈতিক কাজ থেকে শুরু করে সব ঠিকাদারি কাজ তাকেই করতে হবে। অন্য কেউ কাজ চাইলে তাকে শারীরিক ভাবে লাঞ্চিত করতো সে। সর্বশেষ সোনালী ব্যাংকের দক্ষিণ দিকের রেলনাইনের কাজও আরিপ করেছে। স্টেশন রোডের রাস্তার কাজও রিটু আর আরিপ নিয়েছে। ড্রেন করার সময় দোকান মালিকদের কাছ থেকে লাখ লাখ নিয়েছে আরিপসহ একটি সিন্ডিকেট।
পরশুরামে আওয়ামী লীগের দলীয় কাজকর্ম ও বড় দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন ছাড়াও সরকারি বেসরকারি সব কর্মসূচির বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিলো আরিপের নিয়ন্ত্রণে। পরশুরাম সোনালী ব্যাংকের দক্ষিণ পাশে ফুলব্যবসায়ী মহি উদ্দিন জানান, টাকা পরে দেওয়ার কথা বলে তার কাছ থেকে বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, নেতাদের উপহার দেওয়ার জন্য বড় বড় ফুলের নৌকা ও তোড়া বানিয়ে নিতেন আরিপ। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচীর জন্য ফুল নিয়ে যেতেন আরিপ। ফুলের তোড়া মালা নিয়ে নিয়ে যেতেন টাকা ছাড়া। এক পর্যায়ে প্রায় সাড়ে তিনলাখ টাকা বকেয়া হলে টাকা চাইলে গত সংসদ নির্বাচনের সময় ফুল ব্যাবসায়ী মহি উদ্দিনকে নাশকতার মামলায় আসামী করে দেন আরিপ। প্রায় একমাস কারাভোগ করতে হয় তাকে। মহি উদ্দিন আরো বলেন, ওই মামলা পুূলিশ আমিসহ আরো চারজনকে গ্রেফতার করে কোর্টে প্রেরণ করেন।
গত ১৩ মে মাসে পরশুরামের ১৬ জনের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরশুরাম ডিজিটাল ক্যাবল নেটওয়ার্কের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আরো কয়েকজনসহ দখল করে নেয়। ডিশ অফিসে তালা লাগিয়ে বন্ধ করে দেয় পরশুরাম উপজেলার ডিস সংযোগ। শুধু তাই নয় নাসিম কলেজের সামনের তার কেটে নিয়ে ডিশ সংযোগ শতভাগ অকার্যকর করে আরিপ।
প্রায় সপ্তাহ খানেক ডিশ সংযোগ বন্ধ রেখে এক পর্যায়ে প্রায় আড়াই কোটি টাকার ডিশ ব্যবসা আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে নিয়ে দখল করে নেয় আরিপ। ফিড লাইন গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতিমাসে ৬/৭ লাখ মাসিক টাকা তুলে প্রায় পঁচিশ লাখ টাকা আত্বসাত করেন। একই সময় আরিপ ডিশের মোটর সাইকেল, বিভিন্ন যন্ত্রাংশসহ প্রায় বিশ লাখ টাকার মালামাল নিয়ে যান। শুধু তাই নয় ডিশ অফিসে কর্মরত ৫জন স্টাফকে মারধর করে তার আদেশ মানতে বাধ্য করেন। ডিশ মালিক জাকির, ইউনুছ, কালাম, ইকবাল, পিংকুসহ ১৬জন মালিক অভিযোগ করেন বিএনপিকে ব্যবসা করতে দিবে না এবং আরিপ তাদের পিটিয়ে হাতপা ভেঙ্গে দেওয়ার হুমকি দেয়। পিংকু, জাকিরসহ কয়েকজনকে মারধর করে এবং মামলার হুমকি দেয়। বিষয়টি ফেনী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও তার ভাই জালাল উদ্দিন চৌধুরী পাপ্পুকে জানিয়ে ছিলেন মালিকরা।
আরিপ ভারতের সাথে চোরাচালান ও মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত বলে জানায় স্থানীরা। পরশুরাম হাসপাতালে গেইটে ফার্মেসী, ক্লিনিকি ছাড়াও রয়েছে এ্যাম্বুলেন্স, ৩টি হাইচ গাড়ি। স্ত্রী পারভিন আক্তারের নামে রয়েছে কয়েক কোটি টাকা এফডিআর, এছাড়াও রয়েছে অনন্তপুর, পৌরসভার পিছনেসহ পরশুরাম বাজারের রয়েছে তার নিজের নামে ক্রয় কৃত কয়েক কোটি টাকার জমি। বিভিন্ন স্থানে নামে বেনামে রয়েছে আরো বিপুল পরিমান সম্পদ। তার ঘনিষ্ট শাহ আলমের স্ত্রীর নামেও রয়েছে বিপুল পরিমান টাকা। বড় দুই বোনের নামে রেখেছে কয়েক কোটি টাকা।
অভিযোগের বিষয় আরিপের মুঠোফোনে গত এক সপ্তাহ ধরে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তার ব্যবহৃত মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।