নিজস্ব প্রতিবেদক
ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকেই বাকহীন, স্তব্ধ হয়ে গেছেন পিবিআইয়ের পরিদর্শক মাসুদের মা গুলজান বেগম। কাঁদতে কাঁদতে বারবার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন। আহাজারি যেন কোনোভাবেই থামছে না। বারবার বলছেন, “তুমরা আমার কলিজার টুকরো ছেলেকে এনে দাও; আমার ছেলে নেই, এখন কে আমাকে ওষুধ কিনে দিবে? আমার ছেলেকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করেছে, তাদের বিচার চাই।”
মাসুদকে তার গ্রামের বাড়িতেই দাফন করা হয়েছে। পুরো বাড়ি সুনশান নিরবতা। বাড়ির একটি ঘরে খাটে শুয়ে গুলজান বেগম। তার পাশেই দেয়ালে ফ্রেমবন্দি মাসুদের দুটি ছবি। সাদাকালো ছবি হাতে নিয়ে বারবার আদর করার পাশাপাশি গুলজান বেগম এসব কথা বলছিলেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়রাজধানীর রামপুরায় হামলাকারীদের হাতে নির্মমভাবে হত্যার শিকার হন পিবিআইয়ের পরিদর্শক (ওসি) মাসুদ পারভেজ ভুঁইয়া। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের কালান্দরে চলছে শোকের মাতম। তার পরিবার বলছে, মাসুদের সারা শরীরজুড়ে ছিল অস্ত্রের কোপ আর রড দিয়ে পেটানোর জখম। ১৯৯৬ সালে উপ-পরিদর্শক হিসেবে পুলিশে যোগদান করেন মাসুদ। পরে পদোন্নতি পেয়ে পরিদর্শক হন। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার আঠারবাড়ি ইউনিয়নের কালান্দর গ্রামের আব্দুল জব্বার ভূঁইয়া ও গুলজান বেগমের আট ছেলে-মেয়ের মধ্যে মাসুদ পারভেজ ষষ্ঠ।
আন্দোলনের মধ্যে ১৮ জুলাই কয়েক হাজার মানুষ গিয়ে তালা ভেঙে মাসুদের কর্মক্ষেত্র নারায়ণগঞ্জের পিবিআই কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। সেদিন তিনি কার্যালয়ে ছিলেন না। ছুটিতে রামপুরার বনশ্রী এলাকায় পরিবারের সঙ্গে ভাড়া বাসায় ছিলেন। পরদিন ১৯ জুলাই বাসা থেকে বেরনোর পর তিনি হামলার শিকার হন। হামলাকারীরা তাকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে ও রড দিয়ে পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে রাখে। পরে রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
কর্মক্ষেত্র নারায়ণগঞ্জ হলেও স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ঢাকার রামপুরা বনশ্রী এলাকায় বসবাস করতেন মাসুদ পারভেজ-মেরিনা আক্তার বীনা দম্পতি। তাদের বড় মেয়ে উম্মে মাইশা স্নেহা ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। মেঝ মেয়ে উম্মে মাহিরা নেহা এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। সবার ছোট ছেলে আহনাফ মাহিন ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে।
পরিবারের সদস্যরা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না, কেন তাকে হত্যা করা হল? কারণ, ছুটিতে থাকায় সেদিন তিনি ডিউটিতে ছিলেন না। সাদা পোশাকে ছিলেন। ‘পরিকল্পিত হত্যার’ অভিযোগও করেছেন।
মাসুদ পারভেজ ভুঁইয়ার ছোট ভাই সোহেল ভুঁইয়া বলেন, “আমার ভাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে কর্মরত থাকলেও অফিস করতেন ঢাকার বাসা থেকে গিয়ে। ঘটনার দিন বাসা থেকে চা খেতে সন্ধ্যার পর বের হন। পরে অপরিচিত নাম্বার থেকে বাসায় কল দিয়ে জানানো হয়, ভাইকে কুপিয়ে রাস্তার মধ্যে ফেলা রাখা হয়েছে। তাকে এমনভাবে আঘাত করা হয়েছে মানুষ মানুষকে এভাবে কখনও মারতে পারে না। আমি ভাই হত্যার সঠিক বিচার চাই।”
কোটা আন্দোলনের মধ্যে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিন সদস্য নিহত হয়েছেন। তারা হলেন- পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়া, ট্যুরিস্ট পুলিশের এএসআই (নিরস্ত্র) মো. মোক্তাদির এবং ডিএমপির প্রটেকশন বিভাগের নায়েক গিয়াস উদ্দিন। তাদের পরিবারকে আইজিপির ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে অনুদান দেওয়া হয়।
মাসুদ পারভেজের মেরিনা আক্তার বীনা তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বলেন, “প্রধানমন্ত্রী হত্যার বিচারের পাশাপাশি সহযোগিতার কথা জানিয়েছেন। কোনো সহযোগিতা না পেলে তিন সন্তানকে নিয়ে চলা খুব কষ্ট হয়ে যাবে।”
বীনা বলেন, ঘটনার দিন তাকে (মাসুদ) বাস থেকে বের হতে না করেছিলেন। কিন্তু সে সবাইকে সতর্ক করে নিজেই বের হয়ে মৃত্যু ডেকে আনল। তার সারা শরীরে শুধু আঘাত আর আঘাতের চিহ্ন। ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে, রড দিয়ে মাথায় ও শরীরে আঘাত করা হয়। পরে স্থানীয় এক নারী রাস্তা থেকে মাসুদকে তুলে নিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স হাসপাতালে ভর্তি করে।”
সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২১ জুলাই সকালে মাসুদ মারা যান। পরে ওইদিন রাতে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।