নিজস্ব প্রতিবেদক
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যেই গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) বিকেলে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক সংলগ্ন নরসিংদীর জেলা কারাগারে নজিরবিহীন হামলার সময় কোত (অস্ত্রাগার) ভেঙে অস্ত্র ও গুলি লুট করা হয়। জেল সুপার, জেলারসহ ঊর্ধ্বতন কারা সদস্যদের জিম্মি করা হয়। তাদের মারধরও করা হয়। তাদের পরিবারের নারী ও শিশুদের কারা মসজিদে নিয়ে দীর্ঘ সময় আটকে রাখা হয়। তাদের অনেকের হাতে লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র ছিল। পরে কারা কর্মকর্তাদের বাসা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কারা অভ্যন্তরের আরও কিছু স্থাপনায়ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এরপর কারা ফটক ভেঙে ৮১টি সরকারি অস্ত্র লুট করে হামলাকারীরা। এসময় ৮ হাজার ৫০ রাউন্ড গুলি লুট করে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, আন্দোলনের নামে কয়েকশ সশস্ত্র ব্যক্তি প্রথমে কারাফটকে হামলা চালায়। এরপর তারা কারারক্ষীর ওপর হামলা করে অস্ত্র কেড়ে নেয়। কারা অভ্যন্তরে ঢুকে বন্দিদের মুক্ত করে দ্রুত বের হয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলে কারাগারে থাকার ৮২৬ বন্দির সবাই পালিয়ে যান। এর মধ্যে ৯ জঙ্গিও আছে। যার মধ্যে দুইজন অত্যন্ত দুর্ধর্ষ বলে জানিয়েছে সিটিটিসি। হামলার সময় পালিয়ে যাওয়া কয়েদিদের মধ্যে ছিল আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সাত সদস্য ও জেএমবির দুই নারী সদস্য। তাদের মধ্যে সাতজনের পরিচয় পাওয়া গেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের নামে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে ব্যাপক সহিংসতা ও নাশকতামূলক কার্যক্রম পরিচালনার নেপথ্যে উগ্রপন্থি বা জঙ্গি সংগঠনের কারও যোগসাজশ থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (সিটিটিসি) মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, নরসিংদী কারাগারে হামলার ঘটনা ও জঙ্গি ছিনতাই হয়েছে বা ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এই আন্দোলনে যারা নাশকতা চালিয়েছে ও উসকানি দিয়েছে আমরা এরকম ২/১টি গ্রুপকে শনাক্ত করেছি। একজনকে আমরা গতকাল শনাক্ত করেছি, যিনি এরআগে আমাদের হাতে জঙ্গিবাদে জড়িত থাকার অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এই আন্দোলনে তিনি ব্যাপক সহিংস কার্যক্রমে জড়িত ছিলেন। ইতোমধ্যে তার নাম নম্বর শনাক্ত করা হয়েছে। অচিরেই তাকে আমরা গ্রেপ্তার করতে পারবো। তাই আমাদের ধারণা, এই কোটা আন্দোলনে উগ্রপন্থি বা জঙ্গিদের যোগসাজশ বা অংশগ্রহণ থাকলেও থাকতে পারে।
নরসিংদী কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া ৭ জঙ্গির বিবরণ:
পালানো ৯ জঙ্গির মধ্যে শীর্ষ দুই নারী জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। নরসিংদী জেল থেকে পলাতক (অপারেশন গর্ডিয়ান নট) এর সাথে যুক্ত শীর্ষ দুই জঙ্গি হলেন, ইশরাত জাহান মৌসুমী মৌ (৩০) ও খাদিজা পারভীন মেঘলা ওরফে মেঘনা (৩১)। তারা হলি আর্টিজান হামলার পর প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।
বুধবার (২৪ জুলাই) ভোরে সিটিটিসির চিরুনি অভিযানে ঢাকার মিরপুর থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ও ট্রান্সন্যাশনাল ইউনিট গত ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর রাত ৯টা থেকে ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত টানা ৪০ ঘণ্টা নরসিংদী মাধকণী শেখেরচড়ের ভগিরথপুর এলাকার চেয়ারম্যান বাড়ি সড়কে ব্যবসায়ী বিল্লাল মিয়ার ৫ তলা ভবন এবং গাংপাড় এলাকার আফজাল হাজির নিলুফা ভিলা এবং নামক দুটি বাড়িতে ‘অপারেশন গর্ডিয়ান নট’ অভিযান চালায়। অভিযানে দুই জন নিহত হয়, তারা হলেন নব্য জেএমবির আব্দুল্লাহ আল বাঙালি (৩০) ও তার স্ত্রী আকলিমা আক্তার মনি (২৮)। অপর দুই নারী জঙ্গি ছিলেন পালিয়ে যাওয়া ইশরাত জাহান মৌসুমী মৌ (২৪) এবং খাদিজা পারভীন মেঘলা মেঘনা (২৫)। দুজনেই বেসরকারি মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভাসিটির ফার্মেসি বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। এই দুই জঙ্গিই নরসিংদী কারাগারে সাজা ভোগ করছিলেন। কারাগারে হামলার সুযোগে দুইজনই পালান। ২০১৬ সালে হলি আর্টিজানে হামলার পর মিরপুর মডেল থানায় তারা প্রথম গ্রেফতার হয়েছিল। পরে প্রায় এক মাস কারাবন্দী থাকার পর জামিনে ছাড়া পায়। অপারেশন গার্ডিয়ান নটের সময় তারা আত্মসমর্পণ করে।
‘অপারেশন গার্ডিয়ান নট’ – ২০১৮ সালে নরসিংদীর মাধবদীতে দুইটি উগ্রবাদী আস্তানার সন্ধান পায় পুলিশের কাউন্টার টোরোরিজম (সিটিটিসি) ইউনিট। একটি উপজেলার শেখের চর ভগীরথপুর চেয়ারম্যান মার্কেট এলাকায়। অন্যটি মাধবদী ছোট গদাইরচর গাংপাড় এলাকায়। তখন প্রায় টানা ৪০ ঘণ্টা অপারেশন চালান হয়। এসময় পুরো এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানায়, দুর্গাপূজা এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে জঙ্গিরা বড় ধরনের নাশকতার জন্য সংগঠিত হচ্ছে। তারা কোথায় হামলা চালাতে পারে সে বিষয়ে সঠিক তথ্য ছিল না। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নজরদারি বাড়িয়ে জঙ্গি আস্তানা দুইটির সন্ধান পাওয়া যায়। ‘অপারেশন গার্ডিয়ান নট’ – অভিযানে নারীসহ দুই উগ্রবাদী নিহত হয়। সেখান থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। উগ্রবাদীরা সেখানে চারটি বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। অভিযান শুরুর পর দিনভর থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যায়। উগ্রবাদীরা বাসার ভেতর থেকে এবং পুলিশ বাইরে থেকে গুলি ছোড়ে। সেই অপারেশন শেষ হয় মৌ এবং মেঘনার আত্মসমর্পণের মাধ্যমে।
নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলার পর পালিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য ফারুক আহমেদকে (৪৩) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বুধবার (২৪ জুলাই) রাতে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের প্রেমের বাজার এলাকা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ফারুক আহমেদ নরসিংদীর মাদবদী থানার নুরালাপুর এলাকার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। ২০২২ সালে ২৪ মার্চ সিলেটে অভিযান চলিয়ে ফারুক আহমেদকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে তিনি জঙ্গি তৎপরতায় দেশদ্রোহী কাজে জড়িত বলে আদালতে ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এর পর থেকে ফারুক নরসিংদী জেলা কারাগারে ২৮ মাস বন্দী ছিলেন।
নরসিংদি জেলা কারাগারের ৪ নম্বর সেলে ফারুক আহমেদের সঙ্গে ছিলেন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের তিন জঙ্গি, তার হচ্ছেন- হিজবুল্লাহ, আবদুল আলীম ও মঈনুদ্দিন / মহিনউদ্দিন ।
হিজবুল্লাহ ‘এ শতাব্দী ইসলামের বিজয়ের শতাব্দী’ নামে টেলিগ্রাম গ্রুপ খুলে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। ২০২১ সালের (৯ ফেব্রুয়ারি) নরসিংদী থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) । এটিইউর সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি-মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) ওয়াহিদা পারভীন জানান, মঙ্গলবার (৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নরসিংদীর রায়পুরা থানা এলাকায় অভিযান চালিয়ে হিজরুল্লাহ মিয়া ওরফে মো. রাসেল আহমেদকে আটক করা হয়। ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অনলাইনে জঙ্গিবাদ প্রচারণাসহ রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন।
তারা সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদী মতাদর্শ প্রচার ও আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং নাশকতার জন্য পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সিকিউরড গ্রুপ খুলে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা ধর্মীয় সংগঠনের সদস্যসহ, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতাদের টাগের্ট কিলিংয়ের পরিকল্পনা করছিলেন বলে তাদের গ্রুপ চ্যাটিং থেকে পাওয়া যায়।
অনলাইনে জঙ্গিবাদ প্রচারণার অভিযোগে আনসারল্লাহ বাংলা টিম-এবিটি’র সক্রিয় সদস্য আব্দুল আলীমকে ২০২১ সালের (১৫ ফেব্রুয়ারি) গ্রেফতার করে অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। মো. আব্দুল আলিম টেলিগ্রাম গ্রুপ ‘এই শতাব্দী ইসলামের বিজয়ের শতাব্দী গ্রুপের’ অ্যাডমিন হিসেবে কাজ করে আসছিল। অনলাইনে জঙ্গিবাদ প্রচারণাসহ রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল সে। এছাড়া সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রবাদী মতাদর্শ প্রচার ও আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পাশাপাশি নাশকতা পরিকল্পনার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ‘সিকিউরড গ্রুপ’ খুলে নিজেদের মধ্যে চ্যাটিং করে আসছিল।’’
আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সক্রিয় সদস্য মহিন উদ্দিন / মহিউদ্দিনকে ২০২৪ সালের ২৫ এপ্রিল নরসিংদীর বেলাব থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ)। গ্রেপ্তার মহিন উদ্দিন ও তার অন্যান্য সহযোগীরা অনলাইনে জঙ্গিবাদ প্রচারণাসহ রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে তথাকথিত খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন ধরে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। উগ্রবাদী মতাদর্শ প্রচার ও আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং নাশকতার জন্য পরিকল্পনা, প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এছাড়া আগ্রহীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে উগ্রবাদের দিকে আহ্বান করে আসছিলেন।
নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে পালানো আরেক জঙ্গি হচ্ছে জুয়েল ভুইয়া। নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের সক্রিয় সদস্য ছিলেন তিনি। ২০২৩ সালের ১০ অক্টোবর পলাশের ঘোড়াশাল-পলাশ ইউরিয়া ফার্টিলাইজার প্রকল্পসংলগ্ন একটি চায়ের দোকানের সামনে থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। জুয়েল ভূঁইয়া হিযবুত তাহ্রীরের নতুন সদস্য সংগ্রহ ও জনসমর্থন আদায়ে লিফলেট বিতরণের কাজ করতেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন সময়ে কারাগারে হামলার পর তিনি জেল থেকে পালিয়ে যান। তাকে ২৫ জুলাই রাতে গাজীপুরের কাপাশিয়া উপজেলার বরুয়া এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে নরসিংদী জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।