মো. আবুসালেহ সেকেন্দার
সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ ভাগ কোটা রয়েছে। এটি কমিয়ে পাঁচ ভাগ করার দাবি করা হচ্ছে। এই দাবি অনেকের পছন্দ হচ্ছে না। তারা ৩০ ভাগ রাখার পক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরে কলাম লিখছেন, বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান করছেন। কিন্তু বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান বলছে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকারীদের জন্য বরাদ্দ রাখা দশভাগ কোটাও পূর্ণ হয় না। ওই পরিসংখ্যান মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকারীদের জন্য ৩০ ভাগ কোটা রাখার প্রয়োজনীয়তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
মুক্তিযোদ্ধা কোটার দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে যে, যারা মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি পাচ্ছেন তারা সবাই সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষ বা অনগ্রসর নন। এদের অনেকেই আছেন যারা উন্নত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে বড় হন এবং পারিবারিক আর্থিক সচ্ছলতার কারণে সবচেয়ে ভালো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ পান। এদের অনেকে শিক্ষাগ্রহণ ও সরকারি চাকরির পরীক্ষায় প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে এগিয়ে থাকেন। কিন্তু সারা পৃথিবীতে সাধারণত অনগ্রসর মানুষদের মূলধারায় যুক্ত করতে সরকারি চাকরিতে কোটা রাখা হয়।
বাংলাদেশের সংবিধানেও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের ও নাতি-নাতনিদের জন্য বিশেষ কোনও কোটার কথা বলা না হলেও অনগ্রসরদের জন্য প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার কথা বলা আছে। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮ এর দফা ৪ এবং অনুচ্ছেদ ২৯ এর দফা ৩ পড়লে তা পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যারা চাকরি পাচ্ছেন তারা সবাই ওই ধারায় পড়েন না। তাই সংবিধানের ওই ধারা মেনে কেবলমাত্র অনগ্রসর মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকারীদের জন্য কোটা রাখার দাবি করছি।
মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংস্কার করার অর্থ মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাকে অশ্রদ্ধা করা বা অসম্মান করা বিষয়টি এমন নয়। মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংস্কার দাবি করা হচ্ছে এই কারণে যে এই কোটার ফলে প্রকৃত মেধাবীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত লাভ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে যে নিয়োগ পদ্ধতিতে কোটার কারণে কেউ যদি সাড়ে তিন লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২২৬তম হন তাহলে তিনি চাকরি নাও পেতে পারেন। কেননা প্রচলিত ব্যবস্থায় ৫০০ পদের মধ্যে মেধা কোটায় ২২৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া যাবে। ফলে ২২৬তম হয়ে একজন চাকরি না পেলেও শুধুমাত্র কোটা থাকার কারণে আরো অনেক পিছিয়ে থাকলেও সরকারি চাকরি পাওয়া সম্ভব।
সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে কেউ কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করছেন যে, তাহলে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা কি মেধাবী নন? আসলে কে মেধাবী আর কে মেধাবী নন তা সুনির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। জ্বর পরিমাপের জন্য থার্মোমিটার থাকলেও মেধা পরিমাপের কোনও যন্ত্র নেই। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতিতে পরীক্ষায় যারা প্রথমদিকের ফল করেন তাদেরকে মেধাবী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সরকারি চাকরির পরীক্ষা প্রকৃতপক্ষে সবসময় মেধাবীরা নিয়োগ পান বিষয়টি এমন নয়। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফলে যারা প্রথমস্থান অধিকার করেন বা ফলাফলে প্রথমদিকে থাকেন কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন না। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। অনেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে পাড়ি জমান। গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত হন। সুতরাং সরকারি চাকরিতে যারা নিয়োগের জন্য লড়ছেন তারা সবসময়ে সেরা ছাত্র বিষয়টি এমন নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের মধ্যে যারা সরকারি চাকরি পাচ্ছেন এবং যারা পাচ্ছেন না তাদের মধ্যে পার্থক্য উনিশ-বিশ।
কিন্তু এর মানে এই নয় যে, যে বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরি পাচ্ছেন সেই বাছাই প্রক্রিয়ার পরীক্ষায় যারা প্রথম দিকে উত্তীর্ণ হচ্ছেন তাদের বাদ দিয়ে পিছনের সারিতে থাকা কোনও শিক্ষার্থীকে নিয়োগ দেওয়া গ্রহণযোগ্য হবে। এটা কোনোভাবে ন্যায় হতে পারে না।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচারে’র কথা উল্লেখ আছে এবং বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯ এর দফা ১ ও ২ এ সকল নাগরিকের সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা ও মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করার কথা বলা আছে তার পরিপন্থি।
মনে রাখা দরকার, মুক্তিযোদ্ধারা যে ভাতা পাচ্ছেন ও রাষ্ট্রীয় নানা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন তা নিয়ে বাংলাদেশের কোনও মানুষ কখনও প্রশ্ন তোলেনি। আজ যেসব তরুণ মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কারের দাবি করছেন তারাও উপযুক্ত বিষয়ের বিরোধিতা কখনও করেননি। কিন্তু তারা কেন মুক্তিযোদ্ধা কোটার সংস্কার দাবি করছেন সেই বিষয়টি বোঝা দরকার।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিও থেকে দেখেছি, একজন রিকশাওয়ালা প্রশ্ন তুলেছেন কোটা ব্যবস্থা নিয়ে। ভাইরালও হওয়া ওই বক্তব্য যে কারোরই মন ছুঁয়ে যাবে। তিনি শিক্ষিত সমাজের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন তার ছেলেও লেখাপড়া শিখে কি তার মতো রিকশা চালাবে? প্রচলিত কোটাব্যবস্থা থাকলে তার ছেলে সরকারি চাকরিতে ন্যায় সঙ্গত সুযোগ পাবে না এমন আশংকা তিনি ব্যক্ত করেছেন।
বাংলাদেশে ধর্ম নিয়ে কথা বললেই নাস্তিক ট্যাগ দেয়। এখন দেখা যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ কোটার সংস্কার দাবি করলে অনেকে ‘মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী’ ট্যাগ লাগাচ্ছেন। এ ধরনের প্রবণতা অত্যন্ত দুঃখজনক। এর ফলে সমাজে নানা সংকট তৈরি হচ্ছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যেমন বঞ্চিত হচ্ছেন তেমনি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দৈনিক সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে বগুড়ায় রফিকুল ইসলাম নামে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা অর্থের বিনিময়ে সাত ভুয়া সন্তানকে সরকারি চাকরি দিয়েছেন। আমরা এতদিন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার কথা জানলেও আজ মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সন্তানের কথা জানছি। এই সব ঘটনা কি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সম্মানজনক?
ওই সব ঘটনায় প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য ও মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাসী মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়।ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ যারা জোগাড় করেছে তারা কীভাবে পেয়েছেন? মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কমান্ডাররা কেন তাদের চিহ্নিত করলেন না? সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র বাতিল করা যাচ্ছে না। কারণ রফিকুল ইসলামের মতো অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা অর্থগ্রহণের বিনিময়ে অনেককে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বা তার সহযোদ্ধা বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন। তাই এই ধরনের ঘটনা বন্ধ করা দরকার। আর এসব বন্ধ করা তখনই সম্ভব হবে যখন মুক্তিযুদ্ধকে ‘অসৎ ব্যবসায়ীদের’ খপ্পর থেকে রক্ষা করা যাবে। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার হার কমে গেলে ‘মুক্তিযুদ্ধজীবী’দের ব্যবসা কমে যাবে। তখন মুক্তিযোদ্ধা সাজতে খুব বেশি আর কেউ আগ্রহী হবে না। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারবেন।
মুক্তিযোদ্ধা কোটা নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলোও আমলে নেওয়া দরকার। অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র নেই। আবার অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র রয়েছে।
এছাড়া আছে সিক্সটিন ডিভিশন নিয়ে অনেক প্রশ্ন। ২০২০ সালে কিংবদন্তিতুল্য নাট্যশিল্পী ও নির্মাতা মামুনুর রশীদ দৈনিক কালের কণ্ঠে একটি উপ-সম্পাদকীয় লেখেন। যেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমি ঢাকায় ছিলাম না। দিন দশেক পরে ঢাকায় ফিরে যখন বিজয়ের আনন্দে আমরা উদ্বেলিত, তখনই জানতে পারলাম ঢাকায় নাকি একটি সিক্সটিন ডিভিশন হয়েছে। এই ডিভিশনের কাজ হচ্ছে, এরা অস্ত্র ও ছিনতাই করা গাড়ি নিয়ে লুটপাটের কাজে নেমেছে এবং বিহারিদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি অধিকার করছে। জানামতে, এদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কোনো প্রমাণ নেই।’
এছাড়াও রাজাকার থেকেও অনেকে হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধা গবেষক সালেক খোকনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর উপজেলার গোসাইবাড়ি গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. হাবিবুর রহমান আক্ষেপ করে বলেছেন, ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হবার পর যেসব রাজাকার তার নিকট আত্মসমর্পণ করেছিল তারা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধার সনদ জোগাড় করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে।
বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারি চাকরি পেতে সনদ না থাকা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকারীদের ওই ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের, সিক্সটিন ভিডিশনের মুক্তিযোদ্ধাদের এবং রাজাকার থেকে মুক্তিযোদ্ধা হওয়াদের উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে লড়তে হচ্ছে। সরকারি চাকরির পরীক্ষায় সনদপত্র না থাকা প্রকৃত অনেক মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকারীরা সেরাদের মধ্যে স্থান করে নিয়েও শুধুমাত্র কোটার কারণে অনেক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার উত্তরাধিকারীদের জন্য সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এই বঞ্চনার দায় কে নেবে?
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একজন সাংবাদিক প্রশংসা করে বলেছিলেন তিনি বাংলাদেশের সর্বাধিকবার নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী। এর উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, তার বড় পরিচয় তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। প্রকৃতপক্ষে এরচেয়ে বড় পরিচয় হতে পারে না। হাজারবার জন্মালেও বাংলাদেশের দ্বিতীয় কোনও মানুষের পক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা হওয়া সম্ভব নয়।
একইকথা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। হাজারবার জন্মালেও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সম্ভব নয়। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকারীরা তাই ভাগ্যবান। তাদের ওই বিশেষ সৌভাগ্যবান পরিচয়কে কোটার যাঁতাকালে ফেলে পিষ্ট করা হচ্ছে। সরকারি চাকরিতে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কোটার ফ্রেমে ফেলে আদৌও মুক্তিযোদ্ধা ও তার পরিবারকে সম্মানিত কি করা হচ্ছে?
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়