পলাশ আহসান
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে বাইডেন ট্রাম্প বিতর্ক হয়ে গেল। দুই দলের দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মন খুলে একে অপরের সমালোচনা করলেন। সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হলো বর্তমান প্রশাসনের অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিয়ে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী বিতর্কে এগিয়ে গেছেন রিপাবলিকানদের ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে এই এগিয়ে যাওয়া খুবই কাঙ্খিত। যেকোনো মূল্যে সবাই এখানে এগিয়ে থাকতে চায়। তাই এখানে ট্রাম্পের যৌন কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গ হাজির করেন বাইডেন। সেই তোপের মুখেও বাইডেনের ব্যক্তিগত ইস্যু তার ছেলের হান্টার বাইডেনের অবৈধ অস্ত্র কেনার বিষয়টি তোলেননি ট্রাম্প। তাতে কী দাঁড়ায়? সবার হাতে হাতে অস্ত্র থাকার ব্যাপারে সব সময় সায় আছে রিপাবলিকানদের।
এর আগেও যখন যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্র নিয়ে স্বেচ্ছাচার বন্ধের প্রসঙ্গ এসেছে তখন দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের কাউকেই কার্যত কঠোর হতে দেখা যায়নি। অথচ, গোটা যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা পৃথিবীর সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় আছে বলে পরিসংখ্যান দিচ্ছে মানবাধিকার রক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো। সবচেয়ে অনিরাপদ অবস্থায় আছে অভিবাসী এবং অশেতাঙ্গরা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর অনুসন্ধানও তাই বলছে। প্রতিদিনই অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের খবর আসছে। বেশির ভাগেরই বিচার হচ্ছে না। ভোটের কথা চিন্তা করে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের কেউ সেই অর্থে কোনো উদ্যোগও নিচ্ছে না। কিন্তু তারা সারা পৃথিবীর মানুষকে মানবাধাধিকার রক্ষার জ্ঞান দিচ্ছেই। আপাত দৃষ্টিতে কোথাও মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে মনে করলে, বিচার বিবেচনা না করে শাস্তিও দিচ্ছে।
মোদ্দা কথা তারা শোধরায় না। লেখার শুরুতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেন আগ্নেয়াস্ত্র কেনার সময় মিথ্যা তথ্য দেয়ার প্রসঙ্গ এনেছিলাম। দেখুন এই হান্টার মাদকাসক্ত হওয়ার পরেও বলেছেন তিনি মাদকাসক্ত নন। প্রভাব খাটিয়ে অস্ত্র বিক্রেতার নথিতে মিথ্যা তথ্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন। পাশাপশি ১১ দিন অবৈধভাবে কেনা আগ্নেয়াস্ত্রটি নিজের কাছে রেখেছেন। ডেলাওয়্যারের উইলমিংটনের ফেডারেল আদালতের বিচারে ১২ জন জুরির কাছে এই ৩টি অভিযোগই প্রমান হয়েছে। ৫৪ বছর বয়সি হান্টার এই রায় দেয়ার সময় প্রায় প্রতিক্রিয়াহীন ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, অস্ত্র কেনার সময় তিনি মাদকাসক্তি থেকে বের হয়ে এসেছিলেন।
রায়ের আগে বাইডেন বলেছিলেন, রায় যাই হোক তিনি মেনে নেবেন। রায়ের পর ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট। রায়ের আগে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট, কিন্তু আমি একজন বাবাও। হান্টার এখন মানুষ হয়ে উঠেছে, সে জন্য আমরা খুবই গর্বিত। আমি ও আমার স্ত্রী সব সময় হান্টারের পাশে থাকব এবং আমাদের পরিবারের বাকি সবাই ভালোবাসা ও সমর্থন নিয়ে তার পাশে থাকবে।’ বিচারক সাজা ঘোষণার জন্য কোনো তারিখ দেননি। তবে জানান, ১২০ দিনের মধ্যে রায় কার্যকর হবে। এই ইস্যুতে মার্কিন আইনে ১৫ থেকে ২১ মাস সাজা দেয়ার নিয়ম রয়েছে। তবে আইন বিশেষজ্ঞরা গণমাধ্যমে জানান, এধরণের মামলায় দোষীরা সহজ সাজা পান।
এই পুরো বিষয়টা গত দুই মাস ধরে পত্রপত্রিকায় আসছে। তবুুও আলোচনার সুবিধার জন্যে আরেকবার বললাম। অপরাধ যেখানে মিথ্যা তথ্য দিয়ে অস্ত্র কেনার মত গুরুতর, সেখানে সার্বিক পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে খুব সাধারণ কোন ঘটনা। যেটার বিচার না করলেও চলে। খোদ রাষ্ট্রপতিও বিষয়টি দেখছেন সাধারণ বিষয় হিসাবে। সব শেষ বিরোধীদরের প্রধান নেতাও সেরকম আচরণ করলেন। যেন কিছুই হয়নি। বিষয়টা আসলেই তাই। গোটা যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যাবহার সংস্কৃতি তাই বলে। সারা পৃথিবীর মানুষকে মানবাধীকার রক্ষার জ্ঞান বিতরণকরা যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ নাগরিক মনে করেন, অস্ত্র রাখা তার মৌলিক অধিকার।
অস্ত্র ব্যবহারের মতো বিষয় যারা অবাধ করতে চায়, তারা অস্ত্র কেনার জন্যে দু-একটা মিথ্যা বলাটাকে অপরাধই মনে করবে না সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু পৃথিবীর অন্য যেকোনো দেশ হলে প্রশ্ন আসতে পারতো। এমনিতেই তো রাষ্ট্রপতি পুত্রের নিরাপত্তা পাওয়ার কথা। তাকে মিথ্যা বলে অস্ত্র রাখতে হবে কেন? ব্যক্তিগত অস্ত্র রাখার এত তাড়া কেন তার? অস্ত্র নিয়ে তিনি কী করতে চেয়েছিলেন? সেটা কতটুকু মানবাধিকার সম্মত? কিন্তু দেশটির নাম যখন যুক্তরাষ্ট্র, তখন সেসব প্রশ্নের বালাই নেই। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশ যারা প্রতিনিয়ত যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার রক্ষার ঘেরাটোপে পড়ে, সেব দেশের মানুষেরা এই প্রশ্ন তুলতেই পারেন।
যুক্তরাষ্ট্রে অস্ত্রের অবাধ ব্যবহার নিয়ে লোক দেখানো রাজনৈতিক বিভক্তি রয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভাল হান্টারের বাবা বাইডেনের ডেমোক্রটিক দল রাজনৈতিকভাবে অস্ত্রের অবাধ ব্যবহারের বিপক্ষে। তাদের কংগ্রেস, সিনেট, গণমাধ্যমে প্রায়ই দুই দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক হয়। কিন্ত অস্ত্রের অবাধ ব্যবহারের বিপক্ষে থাকা ডেমোক্রেটরা ক্ষমতায় থাকার পরেও অস্ত্রের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ হয় না। একের পর এক গোলাগুলি হচ্ছেই। যে কারণে বলা হয় ডেমোক্রেটদের এই বিরোধিতা কাগজে কলমে আটকে আছে।
যুক্তরাষ্ট্রে সংবিধান তৈরি হয় ১৭৮৭ সালে শুরু হয়ে ১৭৮৯ সালে শেষ হয়। ১৭৯১ সালে একটা সংশোধনী আসে। সেখানে বলা হয়, কখনও কেন্দ্রীয় সরকার অন্যায়ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে চাইলে যে কোন নাগরিক অস্ত্রের ব্যবহার করতে পারবে। ১৮৮১ থেকে ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত গুহযুদ্ধ এই প্রয়োজনীয়তা আরও বাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘ সময় পর ১৯৬০ এর দশকে দলগত হানাহানি বেড়ে যাওয়ায়, প্রেসিডেন্ট কেনেডি হত্যার পর প্রথম অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইন নিয়ে আসে মার্কিন প্রশাসন।
এই সাংবিধানিক ও ঐতিহাসিক ভিত্তি থাকার কারণে বেশিরভাগ মার্কিনী মনে করেন অস্ত্রের ব্যবহার তাদের মৌলিক অধিকার। এর পরিবর্তন তাদের কাছে অবমাননার মত। নাগরিকের এই মনোভাব সবচেয়ে বেশি বোঝে রিপাবলিকানরা। তাই তারা সরাসরি তারা ব্যক্তিগত অস্ত্রের ব্যাবহার মৌলিক অধিকার হিসাবে রাখার পক্ষে। আর ডেমোক্রেটরা ওপরে ওপরে না না করে, কিন্তু অনুশীলনের যায়গায় অস্ত্রের পক্ষেই থাকেন।
মানবাধিকারের সবকদাতা যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর অস্ত্রব্যবসায়ীরা। তারা রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণ করে। অস্ত্র অধিকার সমর্থনকারী রাজনীতিকরা পার্লামেন্টে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে যেন আইন পাশ না হয় তা নিশ্চিত করেন। বিষয়গুলো সেদেশে এতটাই প্রকাশ্য যে, তাদের গণমাধ্যম এই প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছে ‘গান লবিং’ । গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত, বন্দুকের পক্ষের লোকজন শুধু লবিং করতেই, ১৭২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে। তাদের ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন শুধু ২০২০ সালেই অস্ত্র অধিকার রক্ষায় খরচ করে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
যুক্তেরাষ্ট্রে অনেক রাজ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত গুলিভরা অস্ত্র বহন করার অনুমতি রয়েছে। কোনো কোনো রাজ্য আছে, যেখানে কোন বাড়িতে মানুষ যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির মালিক যদি মনে করেন, আগন্তুক সন্দেহজনক। তিনি সেই সন্দেহের ওপর ভিত্তি করেই গুলি চালাতে পারেন। পরে তিনি যদি সন্দেহ প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে তার শান্তি হয় না। যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে অস্ত্রের ব্যবহারের বর্ননা লিখে শেষ করা কঠিন। প্রতিবছর গড়ে এক হাজারের বেশি নিরাপরাধ মানুষ মারা যায় বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারে।
এখন প্রকাশ্য হচ্ছে অস্ত্র নিয়ে বাইডেন ও তার দলের দ্বিমুখী চরিত্র। রিপাবলিকানরা তো আগেই তাদের অবস্থান পরিস্কার করেছে। এখন বলা যায় তাদের প্রধান দু’টি রাজনৈতিক দল মানবাধিকারের বিপক্ষেই দাঁড়িয়েছে। যেমনটা তারা সবসময় দাঁড়ান। কিন্তু নানা ছলে ও ছায়ায় ঢেকে রাখেন। কিন্তু হান্টার বাইডেনের অস্ত্র নিয়ে যা হলো তাতে তাদের মানবাধিকার চর্চার স্বরূপ সবাই দেখতে পেলো। আমি জানি না, এখন কী করবেন ফজল আনসারিরা। স্টেট ডিপার্টমেন্টের মুখপাত্রের কাছে কি অস্ত্র নিয়ে হান্টারের প্রমাণিত মিথ্যাচার এবং তার পাশে বাইডেনের দাঁড়ানো নিয়ে প্রশ্ন করবেন? না কি প্রেসিডেন্ট বিতর্কে ট্রাম্পের অস্ত্র নিয়ে প্রশ্ন না করা নিয়ে কথা বলবেন? না পুরো বিষয়টি চেপে গিয়ে নিজের পরিচয়পত্র রক্ষা করবেন ?
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।