৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ |
  • প্রচ্ছদ
  • টপ নিউজ >> মতামত
  • রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারকে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে
  • রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারকে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে

    দৈনিক আমার ফেনী

    ড. প্রণব কুমার পান্ডে
    মানবিক বিপর্যয়ের ইতিহাসে খুব কম ঘটনাই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং সাধারণ উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে যতটা জোরালোভাবে করেছে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী মূলত রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গাদের ওপর নিরলস নিপীড়ন চালিয়েছে, যার ফলে ২০১৭ সালে ১.১ মিলিয়নেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ ঘটেছে। এই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নির্দয় অভিযানে নৃশংসতার ভয়ঙ্কর গল্পগুলো বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন গণমাধ্যমে রিপোর্ট করা হয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায় এটিকে জাতিগত নির্মূল হিসাবে নিন্দা করেছে।

    বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই মানবিক সংকটে সাড়া দিয়ে দেশের সীমান্ত খুলে দেওয়ার এবং অকল্পনীয় নৃশংসতা থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তিদের আশ্রয় দেওয়ার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মানবাধিকার এবং বিশ্ব মানবিকতা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের উৎসর্গ, সহানুভূতি ও একাত্মতা ঘোষণা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। বিদেশি দাতাদের সহায়তায় বাংলাদেশ গত কয়েক বছরে এই বাস্তুচ্যুত মানুষদের বিশাল দায়িত্ব বহন করে চলেছে।

    তবে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন ধরনের কূটনৈতিক উদ্যোগ সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন একটি দূরবর্তী লক্ষ্য হিসাবে রয়ে গেছে। মূল কারণ হলো সমস্যাটি সমাধানে মিয়ানমার সরকারের ইচ্ছার অভাব, পাশাপাশি কিছু পরাশক্তির আন্তরিক সমর্থনের অভাব।

    সম্প্রতি ২৫ মে আল-জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আরাকান সেনাবাহিনী এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে চলমান দ্বন্দ্ব কেবল রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনেই বিলম্ব করেনি, বরং আরও ৪৫ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষকে পালাতে বাধ্য করেছে যারা বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থান করছে। শিরচ্ছেদ, হত্যা এবং সম্পত্তি পোড়ানোর খবর সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। জাতিসংঘ ভয়াবহ এই পরিস্থিতির বিষয়টিকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেছে।

    রাখাইন রাজ্যের জটিল গতিবিধি রোহিঙ্গাদের এক অসহনীয় পরিস্থিতিতে ফেলেছে। সে দেশের সেনাবাহিনী দ্বারা রোহিঙ্গারা দীর্ঘকাল ধরে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নৃশংসতার শিকার হয়ে আসলেও তাদের দুর্ভোগের কোনও প্রকৃত সমাধানকে হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা শরণার্থীদের সহায়তা করে চলেছে যা তার ক্ষমতা এবং সম্পদের ওপর কর চাপ সৃষ্টি করছে।

    বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি সহানুভূতি জানানোর জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রথমদিকে এগিয়ে আসলেও, সময়ের সাথে সাথে রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার জন্য যৌথ প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনায় (জেআরপি) অর্থায়ন নাটকীয়ভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই ঘাটতি পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করেছে এবং বর্তমান শরণার্থীদের সার্বিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া বাংলাদেশের জন্য আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। সহায়তার পরিমাণ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের ওপর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

    বর্তমান প্রেক্ষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো প্রত্যাবাসন প্রকল্পগুলোর জন্য পর্যাপ্ত তহবিল এবং প্রকৃত সহায়তা দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনীহা। ফলে, বাংলাদেশ অতিরিক্ত বোঝা বহন করে চলেছে। এই অবস্থা অনির্দিষ্টকালের জন্য এভাবে চলতে পারে না। বিশ্ব সম্প্রদায়ের উচিত সমস্যার গভীরতা অনুধাবন করে আর্থিক অবদানের পাশাপাশি সমস্যার অন্তর্নিহিত কারণগুলো সমাধানের জন্য রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এবং কূটনৈতিক উদ্যোগ বৃদ্ধি করা।

    সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান প্রদেশে আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার শান্তিরক্ষী বাহিনীর মধ্যে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলেছে। আরাকান আর্মির সাথে না পেরে ইতোমধ্যেই মিয়ানমান বর্ডার গার্ড পুলিশের বেশ কিছু সদস্য কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছিল। পরবর্তীতে দুই দেশের কর্মকর্তাদের আলোচনার প্রেক্ষিতে সেই সকল সদস্যদের দেশে ফেরানো সম্ভব হয়েছে।

    আরাকান প্রদেশে ক্রমবর্ধমান সহিংসতা এবং সেখানে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল তৈরি করতে মিয়ানমার সরকারের স্পষ্ট অনিচ্ছার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশকে অবশ্যই একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে না নতুন করে শরণার্থীদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেওয়া। এই সিদ্ধান্ত হবে একটি বাস্তববাদী সিদ্ধান্ত।

    মানবাধিকার সংস্থাগুলোর আহ্বান সত্ত্বেও, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আর কোনও রোহিঙ্গা অভিবাসীদের আগমনকে স্বাগত জানানো উচিত হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের সম্পদ ইতোমধ্যেই সীমিত হয়ে গেছে। বর্তমান অবস্থানরত ১.১ মিলিয়নেরও বেশি শরণার্থী (যাদের মধ্যে উচ্চ জন্ম হারের প্রবণতা রয়েছে) দেশের সম্পদের ওপর চাপ ফেলতে শুরু করেছে।

    সাম্প্রতিককালে রোহিঙ্গা অভিবাসীদের জন্য বৈদেশিক অর্থায়নের হ্রাস সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তুলেছে, যা বাংলাদেশে বসবাসরত শরণার্থীদের পর্যাপ্ত সহায়তা প্রদানকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে। বাংলাদেশ সরকার সব সময় মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে, সরকারে উচিত তাদের সক্ষমতার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দিবেচনা করা। বিশ্ব সম্প্রদায়কে সমস্যার অন্তর্নিহিত কারণগুলো মোকাবিলা করতে এবং স্থায়ী সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য প্রচেষ্টা বাড়াতে হবে।

    বৈশ্বিক শক্তি এবং আঞ্চলিক অনুঘটকদের অবশ্যই মিয়ানমারের অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় আরও আগ্রাসীভাবে কাজ শুরু করতে হবে। কূটনৈতিক চাপ, নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সামরিক সরকারকে তার অপরাধ বন্ধ করতে এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য নিরাপদ পরিস্থিতি তৈরি করতে বাধ্য করতে হবে।

    তাছাড়া বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সহায়তা করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে জেআরপি এবং অন্যান্য প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য আরও একবার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সমস্যাটির বৈশ্বিক প্রকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে, আমাদের মানবিক সহায়তাকে দাতব্যের পরিবর্তে একটি যৌথ বাধ্যবাধকতা হিসাবে দেখা উচিত। রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয়তা ও পরিষেবাগুলোতে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে ধনী দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে অবশ্যই অবিচ্ছিন্ন ও উল্লেখযোগ্য সহায়তা প্রদান করতে হবে।

    রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ আমাদের মানবাধিকারের দুর্বলতা এবং ধর্মীয় ও জাতিগত গোঁড়ামির ভয়াবহ পরিণতির কথা মনে করিয়ে দেয়। যদিও বাংলাদেশ এই ইস্যুতে সহানুভূতি দেখিয়েছে, তবে এটি নিশ্চিত যে সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে সরকার অনেক চাপের মধ্যে পড়েছে। যারা এই মানবিক বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের সাহায্য করতে এবং এর উৎপত্তিস্থলে পরিস্থিতি সমাধান করতে, সমগ্র সম্প্রদায়কে জোরালোভাবে এবং একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

    মানবতার এক বিস্ময়কর মাত্রা প্রদর্শন করা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে বাংলাদেশ একটি সংকটময় মুহূর্ত পার করেছে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় তৎপরতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া জানানোর দায়িত্ব আজ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের।

    বর্তমান প্রেক্ষিতে, একটি সমন্বিত ও অবিচ্ছিন্ন বৈশ্বিক প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কেবল রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ কমানো এবং এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব।

    লেখক: অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

    আরও পড়ুন

    যুবকদের প্রশংসা করলেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা এএফ হাসান আরিফ
    ফেনীতে বন্যাদুর্গতদের বিজিবির চিকিৎসা ও ওষুধ প্রদান
    ফেনীর বন্যা পরিস্থিতির কোথাও উন্নতি, কোথাও অবনতি
    বানের জলে ভাসিয়ে দেয়া হলো শিফুকে
    দাগনভূঞায় কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিলো বিনা
    মিরসরাইয়ের ঝর্ণায় ঘুরতে এসে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে দুই পর্যটকের মৃত্যু
    পরশুরাম ও ফুলগাজীতে তৃতীয় দফায় বন্যা
    ডেইলি মুহুরী ডট কমের উদ্বোধন