জমির বেগ
আজ মহান স্বাধীনতা দিবস। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাত্রে ঘুমন্ত বাঙালির উপর অতর্কিত হামলা শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী শুরু করে গণহত্যা। এ গণহত্যা অপারেশন সার্চলাইট নামে পরিচিত।
পাকিস্তান হানাদার বাহিনী সেনা অভিযান শুরু করেই বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের আগ মুহূর্তে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি যো কোন মূল্যে শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানান। বঙ্গবন্ধুর আহবানে বাঙালি জাতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমার পাই স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ। বিশে^র মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
বাঙালির স্বাধীনতা কিন্তু একদিনে আসেনি। দীর্ঘ পরিক্রমায় এসেছে এ স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই সোনার বাংলার স্বপ্ন লালন করতেন। অবশেষে তিনি তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে ছেড়েছেন। বাঙালির জাতির ঐতিহাসিক দিবস ৫২ ভাষা আন্দোলন, ৫৪ যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৬৬টির ৬দফা, ৬৯এর গণঅভ্যুত্থান সব কিছুর নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ৭০এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। তারপর ক্ষমতা না দেয়ার জন্য নানান টালবাহানা শুরু করে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ৭১এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে দেশবাসীকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগাম মুক্তির সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ মুজিবের এই ভাষন শুধু দেশে নয় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করা বাঙালিরদের রক্তও স্বাধীনতার জন্য টগবগিয়ে উঠে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাস করা বাঙালিরাও যুদ্ধে অংশ গ্রহন করার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে।
বর্বর পাকিস্থানি হানাদার বাহিনী ৭১ এর নয় মাসজুড়ে শুধু আমাদের রক্ত ঝরায়নি, মা-বোনের ইজ্জত নেয়নি, তারা হাজার হাজার গ্রামে লাখ লাখ অসহায় মানুষের বাড়ি-ঘরে আগুন দিয়ে গ্রামগুলোকে পুড়িয়ে করে দিয়েছে অঙ্গার। মাথার ওপর থেকে ছাদটা কেড়ে নেয়ায় সব হারিয়ে ১ কোটি মানুষকে আশ্রয় নিতে হয়েছে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে। তাদের অগ্নিসন্ত্রাসে দেশের ৮ কোটি মানুষের মধ্যে আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিল প্রায় ৩ কোটি মানুষ। তারপরও যুদ্ধে জিতেছি আমরা। সা¤্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদ ও সহযোগীতায়ও টিকতে পারেনি পাকিস্থানি বাহিনী। আতœসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল তারা। যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েও ঠেকাতে পারেনি বাংলাদেশের বিজয়। সে ক্ষোভেই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশকে বলেছিল তলাবিহীন ঝুড়ি। বঙ্গবন্ধু ধবংসস্তুপ বাংলাদেশকে পুনঃগঠন করেছিলেন।
১৯৭২-৭৩ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রধান রবার্ট ম্যাকনামারা বলেছিলেন, বাংলাদেশকে সব সময় বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভর করে চলতে হবে। যে কোন রাষ্ট্রের জন্য এভাবে টিকে থাকা অসম্ভব। বিশ্ব ব্যাংকের ১৯৭৩ সালের প্রতিবেদনেও ছিল দেখা যাক বাংলাদেশ কত দিন টেকে ও কীভাবে টেকে। জনগন দরিদ্র। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলার। মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা বাংলাদেশকে ক্রমেই অস্তিত্ব সংকটে ঠেলে দিবে। বিশ্ব ব্যাংকের সে ভবিষ্যদ্বানী মাত্র ৫০ বছরে বাংলাদেশ মিথ্যা প্রমান করেছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জিডিপি প্রবৃদ্ধির দেশ।
গত শতকের ষাট দশকের শুরুতেই বঙ্গবন্ধু উপলব্ধি করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার দরকার। তার জন্য ভারতের সহযোগীতা সমর্থন দরকার তাও তিনি অনুধাবন করতেন। করতেন বলেই তিনি ভারতের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। বঙ্গবন্ধু যখন ৬ দফার ঘোষনা করেন তখন আওয়ামী লীগ নেতাসহ অনেকেই ৬ দফার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন এটি দেশদ্রোহের শামিল। আইয়ুব খাঁন সকলকে ফাঁসিতে ঝুলাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ৬ দফার উপর অনড় থেকে এগিয়ে যান এবং বললেন কেউ না আসলেও তিনি এককভাবে এগিয়ে যাবেন। তখন তিনি তাজউদ্দিন আহম্মদ ও অন্যান্য অপেক্ষাকৃত তরুন নেতাকে নিয়ে আওয়ামী লীগকে নতুনভাবে পুনগঠিত করেন। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার উপর অনড় থাকার কারনেই ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া খান ব্যর্থ হয়ে পাকিস্তানে ফিরে যান। বঙ্গবন্ধু ৬ দফা এমনভাবে তৈরী করেন, যাতে এটাকে সরাসরি বিচ্ছিন্নতাবাদীর দলিল বলার সুযোগ নেই। অন্যদিকে পাকিস্তান এটিকে মেনে নিলে তার পথ ধরেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষনতা ও কৌশলের কাছে সেদিন পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সামরিক শাসককুল সবাই পরাজিত হয়। তাই এটাই এখন প্রমানিত যে ৬ দফাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য এক নম্বর অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। এই কৃতিত্ব সম্পূর্ণ বঙ্গবন্ধুর একার। ৭০ এর নির্বাচনে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফাকে ও ছাত্রসমাজের ১১ দফাকে অকুন্ঠ সমর্থণ করেন। ৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, ‘ছয় দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। ছয় দফা আজ বাংলার জনগনের সম্পত্তিতে পরিনত হয়েছে। কেউ যদি এর সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত কবর দিবে। এমনকি আমিও যদি করি আমাকেও।’ জনগনের জন্যই ছিল তার রাজনীতি ও কর্মসূচি।
জাতির পিতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। সমগ্র বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়ার সুযোগ পেত না। জাতির পিতা আমাদের শিখিয়ে গেছেন কীভাবে ঝড়-ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ পথে মাথা উঁচু করে সামনের দিকে এগিয়ে চলতে হয়। অধিকার আদায় করে নিতে হয়। নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়। একটি বাস্তবতা হলো অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া কখনও রাজনৈতিক স্বাধীনতা পূনাঙ্গ হয় না। বুকের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা আনা বাঙ্গালী, আমার দেশকে তলাবিহীন ঝুড়িবলা গোষ্টীসহ ও সারা বিশ্বকে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার দুঃসাহস দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু হল একটি আদর্শের নাম। বঙ্গবন্ধু হল একটি চেতনার নাম। যার জন্ম না হলে হয়তো এই দেশ স্বাধীন হতো না। আমরা পেতাম না একটি স্বাধীন ও স্বার্ভভৌম দেশ। একজন মানুষের মধ্যে যত ধরনের গুণাবলি থাকা সম্ভব, বঙ্গবন্ধুর মাঝে তার সবগুলোই ছিল; যে কারণে বঙ্গবন্ধু আজও আমাদের মাঝে উজ্জ্বল, চিরভাস্বর ও স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত। ক্ষমা, দয়া ও দানশীলতা বঙ্গবন্ধুর অন্যতম মহৎ গুণ। বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ছিল ঐন্দ্রজালিক মহাশক্তি। তিনি সফল স্বপ্নদ্রষ্টা, রাজনীতির মহান কবি; তার ভাষণে ছিল অমৃতময় কাব্যিক ব্যঞ্জনা, বাংলা ভাষণে একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বি বাগ্মী। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও বাঙালি জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন সাম্যবাদী, শোষণবিরোধী এবং সুষম অর্থনীতিতে বিশ্বাসী।
৭১সালে তিনি যখন জেলে ছিলেন, তখন জেলে থেকে তাঁর দেশের কোন অবস্থাই জানার সুযোগ ছিলনা। তখন তাঁকে ফাঁসির মঞ্চে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখনও তিনি তাদের সকল আপস প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি যদি তাদের একটি আপস প্রস্তাবে স্বাক্ষর করতেন তাহলে বিশ্বের কোন দেশই আমাদের দেশকে সমর্থন করতেন না।
বঙ্গবন্ধুর একক সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্বে এবং ভুমিকায় এই দেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সীমাহীন ত্যাগ, আদর্শ, চিন্তা, দর্শন ও দূরদর্শিতার কারনেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জীবন, কর্ম, আদর্শ, ত্যাগের দৃষ্টান্ত নতুন প্রজন্মকে জানতে হবে।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি তার একটি লেখায় লিখেছেন, মুজিবের সামগ্রিক মূল্যায়ন করা দুরূহ ব্যাপার। মুজিবুর রহমানের বিশাল কর্মময় জীবন যা তাঁর ধৈর্য, মানসিকতা, দৃঢ়তা এবং অপরিসীম আতœসংযমের পরিচায়ক।
মুজিব মানে বাংলার মুক্তি, মুজিব মানে একটি সোনালি স্বপ্ন, একটি দেশ, একটি পতাকা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ, অধিকার আদায়ের জন্য এক লড়াকু সৈনিক। মুজিব মানে, মহানায়ক, মহাকবি। বঙ্গবন্ধু একটি বাতি। তিনি একটি বাতিঘর। তার বাতিতে পুরো বাঙালি জাতি পেয়েছেন আলোর মশাল।
বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠা। সারা জীবন আন্দোলন সংগ্রাম করে তিনি বাঙালিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা, দারিদ্রমুক্ত ও বৈষম্যহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি আমাদের একটি উন্নয়নশীল, মর্যাদবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালের ২৩ মে বিশ্ব শান্তি পরিষদ কর্তৃক ‘জুলিও ক্যুরি’ পুরুষ্কারে ভুষিত হন। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে সারাবিশ্বে পরিচালত জরিপে শেখ মুজিবুর রহমানকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত করা হয়।
বঙ্গবন্ধু দেশকে স্বাধীনতা দিয়ে যেমন ক্ষুধা, দারিদ্র ও শোষনমুক্ত সোনার বাংলা করতে চেয়েছিলেন তেমনি তাঁর সুযোগ্য কন্য শেখ হাসিনা সেই স্বপ্নযাত্রাকে আরও বিস্তৃত পরিসরে রূপলাভ করে সমৃদ্ধির পথে সাফল্যের সাথে এগিয়ে যাচ্ছেন। দেশ আজ ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উন্নীত হচ্ছে। দেশ আজ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। সর্বশেষ বলবো বঙ্গবন্ধু একটি বাতি। তার বাতিতে পুরো বাঙালি জাতি পেয়েছেন আলোর মশাল।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সংবিধানের এ চার মূলনীতিকে সত্যিকার অর্থেই প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নে ঐক্যবদ্ধভাবে আজীবন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এ জন্য সমগ্র দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করতে হবে।