পলাশ আহসান
এবার কলাম লিখেছেন পিটার হাস। বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাজনীতি বিশ্লেষক এরই মধ্যে গণমাধ্যমে বলেছেন এরকম কলাম লেখা একজন কূটনীতিকের জন্যে শিষ্টাচার বহির্ভূত। কিন্তু আমার মনে হয় এই লেখা লিখে তিনি যতটা না, কূটনৈতিক শিষ্টাচার ভেঙেছেন তার চেয়ে বেশি পক্ষপাতদুষ্ট হয়েছেন এবং তারও চেয়ে বেশি সত্যের অপলাপ করেছেন।
তার লেখায় সবচেয়ে হাস্যকর দিক হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ভাল চায় দাবি করে তিনি লিখেছেন “আমরা আরও উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সমাজের পথ সুগম করতে অর্থপূর্ণ রাজনৈতিক সংলাপের আহ্বান জানানো অব্যাহত রাখব” যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিক শান্তিপূর্ণ সংলাপের আহবান জানাচ্ছে! বিষয়টার বোঝার অনেক কিছু আছে। এটা বিশ্লেষণের জন্যে আমাদের অবশ্যেই একটু পেছেনে যেতে হবে। খুব বেশি দিন আগে নয়, আমাদের সদ্য শেষ হওয়া জাতীয় নির্বাচনের আগে আগের সময়গুলোতে গেলেই হবে। এইতো ২০২৩ এর অক্টোবর নভেম্বরের দিকে…
ওই সময় কোনো শর্ত ছাড়াই আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে শর্তহীন আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু। হাস সাহেব মূলত সেই চিঠি পরিবেশন করার দায়িত্বে ছিলেন। মুহূর্তেই সেই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা। আর শুরুতে সংলাপের কথা বললেও বিএনপিও সেই শর্তহীন সংলাপে রাজি হয়নি।
এর আগে বেশ কিছুদিন বাংলাদেশের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের অংশগ্রহন নিয়ে নাওয়া-খাওয়া ভুলে দৌড়ঝাঁপের মধ্যে ছিলেন হাস। কিন্তু ২৮শে অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের নামে বিএনপি জামায়াতের নজিরবিহীন তাণ্ডবের পর নীরব হয়ে যান। নভেম্বরের সংলাপ মিশন ব্যার্থ হওয়ার পর হাসের সঙ্গে সঙ্গে একেবারে চুপ হয়ে যায় মার্কিন শিবিরও।
হাস এর লেখার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবার সরব হলো মার্কিন শিবির। যদিও নতুন সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে বঙ্গভবনে গিয়েছিলেন হাস। শপথের পরদিনই দেখা করেছিলেন তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে। এরপর ধারাবাহিকভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার কথা বলেছেন বার বার। ওই সময় তাদের দীর্ঘদিনের বন্ধু জামায়াত বিএনপির সঙ্গেও সম্পর্কে শীতলতা আসে।
নির্বাচনের পর যেন কিছুই হয়নি’ মুডে চলে গিয়েছিলেন পিটার হাস। তাই সেরকম একটি প্রেক্ষাপটে দৈনিক প্রত্রিকায় কলাম লিখে রাজনৈতিক সংলাপের আহবানকে দুরভিসন্ধিমূলকই বলছেন বিশ্লেষকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকার বাস্তবায়ন করতে আসেননি পিটার হাস। তিনি নিজ দেশের স্বার্থই দেখছেন। নির্বাচনের আগে পিটার হাস যেসব কথা বলেছিলেন, তাও নিজ দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্যই বলেছেন। মূলত তাদের জাতীয় স্বার্থই এখানে আসল।’
সারা বিশ্বের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি কথা প্রচলিত আছে, “আমেরিকা যার বন্ধু তার শত্রুর প্রয়োজন নেই”। বাংলাদেশের সদ্য শেষ হওয়া নির্বাচনের পর সেই বিশ্বাস বাংলাদেশে আরও দৃঢ় হয়েছে। এই বিশ্বাস আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই দৃঢ় থাকার কথা ছিল। কারণ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা আমাদের ভোলার কথা নয়। তবু আমাদের অনেকের নতজানু মন তাদেরেক এই দেশে জিইয়ে রেখেছে।
মার্কিন কূটনীতিকরা সব সময় বন্ধুত্বের তুবড়ি ফোটায়। কিন্তু তারা কখনও বন্ধু হয় না। হাস সাহেবের আজকের আলেচিত কলামের মধ্যেও সেই বিষয়টি আছে। যেমন তিনি বলছেন, যেসব গণমাধ্যমকর্মী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিয়মতান্ত্রিক দমন ও হয়রানির শিকার হন, তা অবসানের আহ্বান আমরা অব্যাহত রাখব। আসলেই কী তাই? ২০২৩ এর ২৮শে অক্টোবর বিএনপি জামায়াতের কর্মীরা যে ২৮ জন সাংবাদিকের মাথায় বাড়ি দিল এনিয়ে কী হাস সাহেবরা ন্যূনতম কোন কথা বলেছেন? সেই ২৮শে অক্টোবর ভূয়া মার্কিন কূটনীতিকের পরিচয় দিয়ে যে নাটক করা চেষ্টা করেছিল সেটাও কী কোথাও নোটিশ করেছেন? তাহেলে তারা কীভাবে মুক্তমত প্রকাশের পক্ষে থাকলেন?
সম্প্রতি আমেরিকান সংগঠন এনডিআই এবং আইআরআই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। অন্যন্য বিষয়ের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে মিথ্যাচারের প্রসঙ্গটি বার বার এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্যোসাল মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি মিথ্যাচারের শিকার হয়েছেন। এই মিথ্যাচর অবশ্য খুব পুরোনো ট্যাবু, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ফেনী পর্যন্ত ভারত হয়ে যাবে, মসজিদে উলুধ্বনি হবে এসবই বহু আগে থেকে শুনছে বাংলাদেশের মানুষ।
এই সব মিথ্যাচার যারা করছেন, হাস সাহেবরা দিনের পর দিন তাদের পক্ষে থেকে বাংলাদেশকে বিবেচনা করেন। এর পরেও তিনি তার লেখায় বলছেন তারা সব সময় বাক স্বাধীনতার পক্ষে। তার পরেও তিনি লেখেন, যুক্তরাষ্ট্র এখনো বাংলাদেশ ও বিশ্বের সর্বত্র গণতন্ত্রের বিষয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে। কেউ যদি প্রশ্ন করে বিশ্ব নিয়ে তার দেশের গভীর চিন্তার ফলে আজ ইজরায়েল ও মিশরে কী হচ্ছে? পৃথিবীজুড়ে নিরস্ত্র মানুষের প্রতি যে অবিচার হচ্ছে তার সবচেয়ে বেশি দায় কার?
হাসের কথা নিয়ে মুল কথাটি বলেছেন অধ্যাপক ইমতিয়াজ। “তিনি যা লিখেছেন তার দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্যই লিখেছেন, মূলত তাদের জাতীয় স্বার্থই এখানে আসল” আমরাই আসলেই বুঝতে পারি না। বুঝলে ১৯৭১ এর পর তাহলে আমাদের ওপর মার্কিন ছড়ি ঘোরানো বন্ধ হতো। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনের জন্যে আমরা বার বার তাদের কাছে যেতাম না। কিন্তু আবারও আমরা কেউ কেউ যাবো। এই যে দীর্ঘ শীত ঘুমের পর হাসের লেখা প্রকাশ। সেখানে “সংলাপের আহবান”। এখন অনেকেই যেমন একে দুরভিসন্ধিমূলক বলছে, কিন্তু কেউ কেউ এখানে প্রতিপক্ষ দমনের আশাও তো দেখছেন।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী।