জমির বেগ
দাগনভূঞার উপজেলার পূর্বচন্দ্রপুর ইউনিয়ন হাসান গণিপুরে অরফেন্স সেন্টার নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২.৫ একর জমির উপর ২০০২ সালে একটি বহুমুখী শিক্ষা কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন আমেরিকা প্রবাসী মোহাম্মদ নূর। তিনি অরফেন্স সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তার পৈত্রিক ও খরিদা সম্পত্তির উপর নিজস্ব অর্থায়নে নান্দনিক বহুমুখী এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেন। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ভাতা, এতিম দুঃস্থ শিক্ষার্থীদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ যাবতীয় ব্যায় তিনি বহন করেন বলে জানা যায়।
বর্তমানে স্কুলের চার সদস্য বিশিষ্ট একটি এডহক কমিটি গঠন ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে নিয়ে উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগন রয়েছেন শঙ্কায়।
২০২২ সালে প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভূক্ত হওয়ার পর শুরু হয় যত অনিয়ম। জানা যায়, নতুন শিক্ষক নিয়োগ ও বৈধকরণ জটিলতা, চাকুরিরত শিক্ষকদের সাথে নতুন এডহক কমিটির মতপার্থক্য, রাজনৈতিক প্রভাব ও বাহিরে কমিটি নিয়ে গ্রুপিং লবিং এ প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে।
জানা যায় স্কুলটির এডহক কমিটি কয়েকজন ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক পদে নিয়োগ দেন। যারা অর্থ দিতে পারেনি তাদের অন্যায়ভাবে বিদ্যালয় থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পাঠদানে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে বলে দাবি অভিভাবকদের। অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন এসএসসি পরীক্ষার্থীসহ প্রায় তিন শতাধিক অধ্যায়নরত স্কুল শিক্ষার্থী।
জানা যায়, গত বছর ২২ নভেম্বর বোর্ড থেকে অনুমোদিত এডহক কমিটিদের মধ্যে শিক্ষক প্রতিনিধি মো. ইলিয়াছ হোসেনকে না জানিয়ে সিল স্বাক্ষর জাল করে কুমিল্লা বোর্ডে পাঠান স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি। অথচ এসব বিষয়ে শিক্ষক প্রতিনিধি ইলিয়াস হোসেন কিছুই জানেন না বলে জানান। অন্যদিকে অভিভাবক সদস্য রাম প্রশাদ চক্রবর্তীকে না জানিয়ে তার স্বাক্ষর দিয়ে দেন প্রধান শিক্ষক। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক একক ক্ষমতাবলে রেজুলেশন বই, হাজিরা খাতা রাখেন নিজ ঘরে। কাউকে কোন প্রকার তোয়াক্কা না করে খামখেয়ালিভাবে পরিচালনা করছেন দীর্ঘ ২ মাস বিদ্যালয়ের কার্যক্রম।
অভিযোগ রয়েছে সভাপতি সোহেল আহমেদ হারুন ও প্রধান শিক্ষকের যোগসাজশে পুরাতন শিক্ষককে অন্যত্র চলে যেতে বিভিন্ন ভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শণ করছেন। তারমধ্যে অনেকেই ১০-১২ বছর শিক্ষকতা করছেন এমপিওভূক্ত হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে।
জানা যায়, গত বছর অনৈতিকভাবে প্রধান শিক্ষক একজনকে নিয়োগ দিলে গণমাধ্যম কর্মীদের উপস্থিতিতে তিনি পালিয়ে যান। এডহক কমিটির সভাপতি অভ্যন্তরিন বিষয়ে অশালীন আচার-আচরণে ক্ষোভে ও শিক্ষকদের বেতন বোনাস দাবিতে গত বুধবার থেকে তারা ক্লাস বর্জন করেন। তিনদিন পর গত সোমবার উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারসহ শিক্ষকদের আলাপ আলোচনার পর শিক্ষার্থীরা পুনরায় ক্লাসে ফিরে আসেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষকরা জানান, সভাপতি হারুনের নেতৃত্বে বহিরাগতরা তাদের হুমকি-ধামকি দিচ্ছেন। মুখ খুললে তাদের চাকুরি হারানোর ভয় রয়েছে।
চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি শিক্ষক প্রতিনিধি মো. ইলিয়াস হোসেন ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে অব্যাহতি পত্র প্রদান করেন বলে জানা যায়। শিক্ষক নিয়োগ বাণিজ্য, আধিপত্য বিস্তার, শিক্ষার্থীদের মিথ্যা আশ্বাসে দাপটের সাথে পরিচালনা হচ্ছে অনিয়মতান্ত্রিক ভাবে এ প্রতিষ্ঠানটির সকল শিক্ষা কার্যক্রম।
এ বিষয়ে সহকারী শিক্ষক শামীমা ইয়াছমিন জানান, দীর্ঘ ১২ বছর শিক্ষকতা করছি। এ বিদ্যালয়ে এমপিও হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে আছি। কমিটি থেকে অশোভন আচরণে আমরা হতাশ ও লজ্জিত। শিক্ষাক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি আমার বোধগম্য নয়।
ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আবদুস সাত্তার জানান, ২০২২ সালে বিদ্যালয়টি এমপিওভূক্ত হওয়ার পর পুরাতন কমিটি বাতিল করে এডহক কমিটি নিয়মতান্ত্রিকভাবে হয়েছে। যা বোর্ড অনুমোদন দিয়েছে। কমিটি যেভাবে স্কুল চালাবেন সেভাবে চলবে। এখানে ফাউন্ডারের কথা চলে না। এক্ষেত্রে কোন শিক্ষক চলে যেতে চাইলে আমার করণীয় কিছু নেই।
স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমেরিকা প্রবাসী মোহাম্মদ নূর এর সাথে মোবাইলে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, আমাদের বাড়ির দরজায় ২.৫ একর পৈত্রিক ও খরিদা সম্পত্তির উপর ২০২২ সালে একটি বহুমখিী শিক্ষা কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করি। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে অত্র অঞ্চলে একটি সুনামধন্য নান্দনিক বহুমুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলি। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ভাতা, এতিম দুঃস্থ শিক্ষার্থীদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থা, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ যাবতীয় ব্যায় আমরা নিজেরা বহন করি। সরকারের পক্ষ থেকে কোন সুযোগ সুবিধা প্রতিষ্ঠানটি পায় না। ২০২২ সালে বিদ্যালয়টি জুনিয়র স্কুল হিসেবে এমপিওভুক্ত হয়। এমপিওভুক্ত হওয়ার পর থেকে সাবেক দুর্নীাতবাজ ম্যানেজিং কমিটি আবদুস সাত্তার নামে একজন অযোগ্য, অদক্ষ ও জালিয়াত শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে দায়িত্ব প্রদান করেন। তারপর থেকেই ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নানাবিধ অনিয়ম করে চলছেন। তিনি ভুয়া শিক্ষক নিয়োগ, বিভিন্ন রেকর্ডপত্র ঘষা-মাঝা, শিক্ষক হাজিরার বহিতে ফ্লুইড ব্যবহার করে। কর্মরত শিক্ষকদের পদত্যাগি শিক্ষক হিসেবে দেখিয়ে তাদের স্থানে ভুয়া শিক্ষকের নাম সংযোগন করেছে। তিনি কিছু শিক্ষকের বিষয় পরিবর্তন করে ভুয়া ব্যানবেইচ তৈরি করেছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের একান্ত যোগসাজশ ও সহযোগীতা ছাড়া ভুয়া ব্যানবেইচ তৈরী হয়নি। বহিষ্কৃত প্রধান শিক্ষক আবদুস সাত্তারের ভ্রান্তি ও অযোগ্য পরিচালনায় বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক স্থিতি মাপের সকল সূচকে অবনতি ঘটে বিদ্যালয়টি ধবংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। তিনি যে প্রক্রিয়ায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হয়েছিলেন তা প্রতারনা ও অসৎ উদ্দেশ্য প্রনোদিত। কমিটির সকল কার্যক্রম ও অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আমি মার্কিক যুক্তরাষ্ট্র থেকে জেলা প্রশাসক বরাবর দুটি আবেদন পাঠাই। জেলা প্রশাসক মহোদয় সরেজমিনে তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড সহ সংশ্লিষ্ট সকল দপ্তরে প্রেরন করে। জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে আমার সকল অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় কুমিল্লা শিক্ষাবোর্ড তাৎক্ষনিক কমিটিটি বাতিল ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা-অর্থায়ন উন্নয়নসহ সামগ্রিক কার্যক্রমে একক প্রতিনিধি বা সত্ত্বা হিসেবে আবদুস সাত্তারকে দায়িত্ব ও চাকরি থেকে অব্যাহত দিই। বিদালয়ের সিনিয়র শিক্ষক কামরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব অর্পণ করি।
মোহাম্মদ নূর আরো জানান, তখন কোন কমিটি বলবৎ না থাকায়, সরকার কোন আর্থিক দায়ভার গ্রহন না করায় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও সকল প্রকার আর্থিক দায় বহনকারী হিসেবে বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক প্রতিনিধিত্ব করার এখতিয়ার আমি সংরক্ষন করি। বিদ্যালয়ের বহিষ্কৃত প্রধান শিক্ষক আবদুস সাত্তার এখনও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের সহযোগীতায় বিদ্যালয়ে অবস্থান করছেন। তিনি পুনরায় সোহেল আহম্মদ হারুনকে নিয়ে অনেক তথ্য গোপন করে এডহক কমিটি করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। হারুন একজন সন্ত্রাসী। সে শিক্ষক-শিক্ষাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। নিত্য তাদের হুমকি ধামকি দিয়ে থাকে। এসকল কারনে শিক্ষকরা ধর্মঘটেও গিয়েছিলো। জেলা প্রশাসক স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দেয়ার পরও কোন সুরাহা হয়নি। তিনি জানান, বিদ্যালয়ে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে না আসা পর্যন্ত এবং আবদুস সাত্তার বিদ্যালয় থেকে অপসারিত না হওয়া পর্যন্ত আমি শিক্ষক-কর্মচারীদের কোন বেতন ভাতা বহন না করা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এডহক কমিটির সভাপতি দাবীদার সোহেল আহমেদ হারুনকে প্রতিবেদক ফোন করে সালাম দিয়ে নিজের পরিচয় দেন। আপনি অরফেন্স সেন্টারের কি পদবীতে আছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামীকাল দাগনভূঞা আছেন। সরাসরি কথা বলবো। কেন দাগনভূঞায় এসে কথা বলতে হবে এমন প্রশ্নের পর তিনি প্রতিবেদকের মোবাইল কেটে দেন। পরবর্তীতে তাকে ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
উপজেলা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আজিজুল হক জানান, কয়েকমাস যাবত এ বিদ্যালয়ের ফাউন্ডার, এডহক কমিটি ও শিক্ষকদের নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। প্রতিষ্ঠাতা আমেরিকা থেকে সবকিছু বুঝতেছেন না। যদিও তিনি প্রতি মাসে শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ করে আসছেন। সৃষ্ট চলমান সমস্যা নিয়ে ইউএনও ও কমিটির সমন্বয়ে বিদ্যালয়ে একটি সুন্দর পরিবেশ আশা করছি ফিরে আসবে।
দাগনভূঞা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিবেদিতা চাকমা জানান, ব্যাপারটি আমরা পর্যালোচনা করছি। বোর্ড স্কুলটির একটি এডহক কমিটি করে দিয়েছে। তারাই স্কুল পরিচালনা করছেন। সোহেল আহমেদ হারুন এখন স্কুল কমিটির কোন পদে নেই। স্কুলটির শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন এখনও প্রবাসী মোহাম্মদ নূর দিয়ে থাকেন। আসলে বোর্ডের নিয়ম অনুযায়ীই স্কুল চলবে।