নিজামুল হক বিপুল
জর্জ ফ্লয়েডের কথা মনে আছে তো। ২০২০ সালের ২৫ মে যুক্তরাষ্ট্রের মিনসোটা অঙ্গরাজ্যের মিনিয়া পোলিস শহরে পুলিশের হাতে মৃত্যু হয় তাঁর। অবৈধ মুদ্রা রাখার মামলায় কৃষ্ণাঙ্গ এই আমেরিকানকে হত্য করে পুলিশ। ফ্লয়েডের ঘাড়ের উপর হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা ডেরেক চৌভিন। মুত্যুপথযাত্রী ফ্লয়েড তখন বার বার বলছিলেন, ‘আই কান্ট ব্রিদ’ (আমি শ্বাস নিতে পারছি না)। পুলিশ কিন্তু মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁকে ছাড়েনি।
ফিলিস্তিনের গাজায় দিনের পর দিন নির্বিচারে বোমা মেরে নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশুদের হত্যা করছে ইসরাইলি বাহিনী। কই এসব বিষয়ে তো একেবারেই নিশ্চুপ পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশ যক্তরাষ্ট্র। যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেখানেই তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় থাকে সেখোনেই তারা মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা হয়ে দিনরাত চিৎকার করে মানবাধিকার গেল মানবাধিকার গেল বলে চিৎকার করে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, তাদের পথ অনুসরণ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াসচসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। বাংলাদেশেশের মানাবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন। তাদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে দেখলাম, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরাও বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে তারা বলার চেষ্টা করেছেন, টানা চতুর্থবারের মত রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যেন অবশ্যই মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়। দমনমূলক প্রবণতা পরিহার করে এবং অংশগ্রহনমূলক রাজনীতির দিকে ঝোঁকে।
বিবৃতিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কয়েক মাস হাজার হাজার বিরোধী কর্মীকে নির্বিচারে আটক করা বা ভয় দেখানো, সুশীল সমাজ, মানবাধিকারকর্মীদের ওপর হামলা এবং হয়রানি করা হয়েছে। নির্বাচনের আগে বিরোধী ২৫ হাজার নেতাকর্মীকে আটক করা হয়েছে। আরও অনেক বিষয় তারা কথা বলেছেন। বলেছেন, নির্বাচন ঘিরে সহিংসতায় ৫৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের এই বিবৃতি যে একেবারেই মনগড়া, এটা যে কারো বুঝতে খুব সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তারা যে বিবৃতি দেওয়ার জন্য একটা বিবৃতি দিয়েছেন সেটাও খুব পরিস্কার। কারণ বিবৃতির কোন জায়গায় সুষ্পষ্ট কোনো তথ্য তারা উল্লেখ করেনি। প্রথমত, তারা বলেছেন, গত নির্বাচনের আগে নির্বিচারে সরকার বিরোধীদের আটক করা হয়েছে। এখানে তারা বলেনি এই সংখ্যা কত? তারপরেই আবার বলেছেন, ২৫ হাজারের মত নেতাকর্মী আটক করা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের কাছে ঠিকঠাক পরিসংখ্যান নেই। সরকার বিরোধী জোট বিএনপি-জামায়াত বিভিন্ন সময়ে তাদের কর্মী সমর্থকদের আটকের বিষয়ে যেসব মনগড়া তথ্য সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরেছে তার ভিত্তিতে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন একেক সময় একেক রকম বিবৃতি দিয়েছে। সেসব বিবৃতিতে কোন নিশ্চিত সূত্রে উল্লেখ করা হয়নি।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরাও একইভাবে একটা বিবৃতি দিয়েছেন, যার সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। তাছাড়া দেশজুড়ে যেসব সহিংসতা হয়েছে, বাস, ট্রেনে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটেছে, সেসব ঘটনায় যারা গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদেরকেও হিসাবে নিয়েছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা।
আন্দোলনের নামে সাধারণ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার মধ্য দিয়ে মানবাধিকারের যে লঙ্ঘন হলো সে বিষয়ে তাদের বিবৃতিতে একটি শব্দও উল্লেখ করা হয়নি। অথচ তারা মানবাধিকার বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছেন, বিষয়টা খুবই হাস্যকর। তাদের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সুশীল সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীদের ওপর হামলা এবং হয়রানি করা হচ্ছে। এ জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
কিন্তু বিবৃতিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা সুনির্দিষ্টভাবে বলেননি, সুশীল সমাজের কার ওপর কিংবা মানবাধিকারকর্মীদের কার বা কাদের ওপর হামলা ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। অথচ জাতিসংঘ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা ঢালাওভাবে একটা বিবৃতি দিয়ে দিলেন। যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ও বেমানান।
বাংলাদেশে অতীতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু ঘটনা ঘটেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। একই বছরের ৩ নভেম্বর চার জাতীয় নেতাকে জেলের ভিতর হত্যা হয়েছিল। ১৯৭৬ সালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তমকে সামরিক আদালতে সাজানো মামলায় ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন তৎকালীন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান। জিয়ার সামরিক শাসনামলে বহু মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিককে কোনোরকম অপরাধ ছাড়াই তথাকথিত বিচারের নামে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে দেশকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব শূন্য করার চেষ্টা করা হয়েছিল। সেই ঘটনায় সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। এখনও অনেকে সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন।
এই যে এত এত ঘটনা, সেগুলোতে কি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়নি? এসব ঘটনার বিষয়ে তো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো কিংবা জাতিসংঘ মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের কোনো বিবৃতি আমরা দেখি না।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে যেসব মুক্তিযোদ্ধা সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিক বিনা অপরাধে প্রহসনের বিচারের হত্যার শিকার হয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা দশকের পর দশক ধরে বিচারের দাবিতে মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ করেছেন। কিন্তু মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা আন্তর্জাতিক কোনো মানবাধিকার সংগঠনকে বা জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের তো আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে একটা বিবৃতি দিতে দেখিনি। এমনকি উদ্বেগ জানাতে কিংবা তাদের বিচার পাওয়া দরকার, এ বিষয়ে সরকাররের ওপর কোনো চাপ দিতে দেখা যায়নি! অথচ সরকার হঠানোর রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে সহিংসতায় জড়িত মামলার আসামীদের পক্ষে বিবৃতি দিতে দেখা যায় মানবাধিকারের ফেরিওয়ালাদের।
এটাও ঠিক যে, বিরোধী যেসব নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন (সরকারের হিসাবে এ সংখ্যা ১০ থেকে ১৫ হাজারের বেশি না) তারা সবাই যে অপরাধ করেছেন তেমনটা নয়। যারা অপরাধ করেছেন তাদের সঙ্গে কিছু নিরপরাধ নেতাকর্মীও আটক হয়েছেন। অনেকে হয়তো জামিন পেয়েছেন। আবার অনেকে পাননি। এ ব্যাপারে সরকারকে চাপ দেওয়াই যেতে পারে যে, নিরপরাধ ব্যক্তিদের দ্রুত জামিন দেয়া দরকার। কিন্তু এটাও তো সত্য যে, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে এবং যারা নিরপরাধ তারা ঠিকই মুক্ত হচ্ছেন। অন্যদিকে যারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িত, তাদেরকে সাজার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বলে যদি আমরা অপরাধী-নিরাপরাধী সবার মুক্তি দাবি করি তাহলে তো ন্যায় বিচার কখনোই প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাই মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে এক তরফা বিবৃতি দিয়ে মূলত অপরাধীদেরকেই আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে হয়।
বাংলায় একটা বহুলপ্রচারিত প্রবাদ আছে- ‘যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা’ । অর্থাৎ যারে আমি দেখতে পারি না তার সবই খারাপ। আমার মনে হয়, রাংলাদেশে টানা চতুর্থবারের মত শেখ হাসিনার সরকার রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হওয়ায় অনেকেই এটিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারছেন না। এ জন্য নানান ইস্যুতে ঘটনা যতোটা না বড়, তার চেয়ে বড় করে উপস্থাপন করে বিবৃতি দিয়ে মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। অবশ্যই বিবৃতি দেবেন, তার আগে প্রকৃত ঘটনা যাচাই-বাছাই করে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নির্ভর বিবৃতিই আমরা আশা করি।
গণমাধ্যম কর্মী