ড. সুরাইয়া আক্তার
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ইতোমধ্যে সরকার গঠন করেছে। মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতি রোধ, মুদ্রাস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশনা দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছেন।
সংসদীয় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিরোধী দলের গঠন প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হওয়ার পথে। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল সংসদীয় গণতন্ত্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। কেননা সংসদে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতি একদিকে যেমন সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে স্বেচ্ছাচারী হওয়া থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়, অন্যদিকে জনগণের দাবি-দাওয়া ও অধিকার আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করে।
৭ জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দলের অংশগ্রহণ না করায় রাষ্ট্র একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের কর্মকা- থেকে বঞ্চিত হলো বলে অনেকে মনে করেন। তবে সংখ্যায় ১১ জন হলেও জাতীয় পার্টির নির্বাচিত সদস্যগণ একটি সক্রিয় বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন পার্টির চেয়ারম্যান ও সংসদীয় দলের নেতা জি এম কাদের।
নতুন সরকারের অধীনে দেশ যখন পূর্বের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা ও বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধানের পদক্ষেপ নেয়াকে সর্বাগ্রে স্থান দেয়া হচ্ছে তখন নির্বাচনে হার-জিতকে কেন্দ্র করে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে সহিংসতা, হত্যা ও অগ্নিকা-ের মত ঘটনা ঘটেই চলেছে। এর বেশিরভাগ ঘটনায় স্বতন্ত্র ও আওয়ামী লীগ জড়িত বলে বিভিন্ন খবরে উঠে আসছে। এরূপ পরিস্থিতি সরকারের কর্মকা-কে বাঁধাগ্রস্ত করতে পারে। ফলে ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা জরুরী।
নির্বাচন ও নতুন সরকার গঠনকে কেন্দ্র করে এখনো দেশে ও বিদেশে কিছু আলোচনা ও সমালোচনা চলমান রয়েছে। কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন নির্বাচনকে ‘প্রতিপক্ষহীন’ ও দুর্বল হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে। অথচ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অক্ষুন্ন রাখার জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনা ও জনগণের প্রতি প্রতিশ্রুতি রক্ষার দায়িত্ব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর একটি অংশ কেন পালন করেনি তা নিয়ে এ সকল সংগঠনের কোন জোরালো মন্তব্য পাওয়া যায় না।
আবার এক সময়ের যে বৃহৎ দলটিকে সামনে নিয়ে এ সকল মন্তব্যের অবতারণা করা হচ্ছে সেই দলের মধ্যকার নেতৃত্বের সংকট ও জনগণকে আন্দোলন সংগ্রামে আকৃষ্ট করার ব্যর্থতাকে আড়ালে রাখা হচ্ছে। সঠিক বিচারে এই দলটি নির্বাচনে এসে তাদের নেতৃত্ব ও জনসম্পৃক্ততার প্রমাণ দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে দলটি বরং সভা-সমাবেশ ও আন্দোলনের নামে সংহিসতার পথ বেছে নিয়েছে। একই সাথে দেশের জনগণের প্রতি আস্থা রাখার চেয়ে বিদেশি বন্ধুদের উপর নির্ভর করেছে। এ সকল কর্মকা- রূলত দলটির অর্ন্তনিহিত দুর্বলতারই বহিঃপ্রকাশ।
এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পূর্ববর্তী অবস্থানের পরিবর্তন এখন দৃশ্যমান। ইতোমধ্যে নতুন সরকারের সাথে পিটার হাস নিবিড়ভাবে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এর ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যকার যে কূটনৈতিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল তা দূর হবে এবং উভয় দেশের আন্তঃসম্পর্কের স্থিতিশীলতা স্মার্ট ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন। এছাড়া টানা চতুর্থবারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের অভিনন্দন জ্ঞাপন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের ক্ষেত্রে আলাদা গুরুত্বের দাবি রাখে।
আলোচনা ও সমালোচনা যাই হোক, দেশের জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং এ লক্ষ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চলমান প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে উঠার জন্য করণীয় ঠিক করাই এখন সরকারের মূল কাজ। বাংলাদেশের সামষ্টিক উন্নয়নে বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়ন সহযোগী রাষ্ট্র ও সংগঠনের সহযোগিতামূলক মনোভাব এ দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করে। কেননা এই ধরনের মনোভাব সহযোগী রাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে ভূমিকা রাখবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের এই অবস্থান সরকারের কূটনৈতিক সম্পর্কের সাফল্যের ফলেই সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার ফলে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের আজকের এই অবস্থান তৈরি হয়েছে। নির্বাচনকে ঘিরে বিভিন্ন দেশের মধ্যে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা গেলেও নির্বাচনের পরিবেশ ও ফলাফল এ সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটায়। ফলে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক আরও গতিশীল হবে এবং বহুমুখী পথে এগিয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তবে রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বর্তমান সরকারের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে দুর্নীতি দমন ও দ্রব্যূল্য নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বিদেশে অর্থ পাচার রোধ ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অন্যতম। এ সকল সমস্যা সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর অধীনে ইতিপূর্বে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছে তা আরও শক্তিশালী করা জরুরী। তবে বিদ্যমান অবস্থায় সাফল্য আনয়ন সরকারের একার পক্ষে দুরূহ।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পাশাপাশি এর জন্য প্রয়োজন গণসচেতনতা, দেশপ্রেম ও আইন মেনে চলার মানসিকতা, যা অপরাধ প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। সর্বোপরি, একটি সমৃদ্ধ ও স্মার্ট রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ও দলগুলোর মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কের উন্নয়ন অত্যন্ত জরুরী।
একটি গণতান্ত্রিক ও জনবান্ধব রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতিহিংসা পরায়নতা, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জনগণের জানমালের ক্ষতির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে দেশের কল্যাণমূলক কাজের মাধ্যম জনগণের হৃদয় জয় করার প্রচেষ্টাই হোক রাজনীতিবিদদের আগামীর প্রত্যয়, দেশের মানুষের এখন এটুকুই প্রত্যাশা।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।