জমির বেগ
ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার ৬০ শতাংশ কিন্ডার গার্টেনের শিক্ষার্থীরা পাচ্ছেন না নতুন বই। গত ২১ ডিসেম্বর কিন্ডার গার্টেনগুলো উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে বই সংগ্রহ করেন। তার আগে ১৯ ও ২০ ডিসেম্বর সংগ্রহ করেছন উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলো। খোঁজ নিয়ে জানা যায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে তাদের চাহিদার শতভাগ বই দেয়া হলেও কিন্ডার গার্টেন গুলো বঞ্চিত হচ্ছেন বই পাওয়া থেকে। কিন্ডার গার্টেনগুলোকে তাদের চাহিদার শতভাগ বই না পাওয়ায় তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ।
উপজেলার বিভিন্ন কিন্ডার গার্টেনের প্রধানরা জানান, ১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিটি স্কুলে বই উৎসব হওয়ার কথা রয়েছে। শিক্ষা অফিস থেকে দাগনভূঞা উপজেলার প্রতিটি কিন্ডার গার্টেনকে যে হারে বই দেয়া হয়েছে এবার উপজেলার সব শিক্ষার্থী বই উৎসবে অংশ নিতে পারবে না। উপজেলা শিক্ষা অফিসারের স্বেচ্ছাচারিতার জন্য উপজেলার শতভাগ কোমলমতি শিক্ষার্থী বই উৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলেও তাদের দাবী।
জানা যায়, দাগনভূঞা উপজেলার ৩৪টি কিন্ডার গার্টেন সরকারের নিয়মানুযায়ী চলতি বছর অনলাইনে তাদের স্কুলের বইর চাহিদা মোতাবেক আবেদন করেছেন। প্রতি বছর ফেনীর প্রতিটি উপজেলায় চাহিদা মোতাবেক বই দেয়া হয়। কোন প্রতিষ্ঠানে যদি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যায় তখন মার্চ মাসের প্রথমেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অতিরিক্ত বই ফেরত দিয়ে দেয়। আর অতিরিক্ত বই প্রযোজন হলে নতুন করে আবেদন করে শিক্ষা অফিস থেকে বই সংগ্রহ করে নেয়। কিন্ত এবছর জেলার একমাত্র উপজেলা দাগনভূঞা উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নিজ উদ্যোগে কিন্ডার গার্টেন গুলোকে তাদের চাহিদা মতো বই না দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এনিয়ে কিন্ডার গার্টেন গুলোর প্রধানদের সাথে শিক্ষা অফিসারের কথা চালাচালির এক পর্যায়ে তাদের সাথে শিক্ষা অফিসার খারাপর আচরণ করেছেন। দাগনভূঞা কিন্ডার গার্টেন এসোসিয়েশনের বেশ কয়েকজন নেতৃবৃন্দ তাদের সাথে প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ইস্কান্দর নূরী অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন বলে জানান। অভিযোগকারীরা তাদের নাম প্রকাশ না করতে প্রতিবেদককে অনুরোধ করেন। তারা বলেন, জলে বাস করে কুমিরের সাথে যুদ্ধ করা যায় না। আমরা যেহেতু প্রতিষ্ঠান চালাবোই প্রতিবাদ করলে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে আমাদের।
পূর্ব চন্দ্রপুর ইউনিয়নের ফুলকলি মডেল কিন্ডার গার্টেন এন্ড জুনিয়র হাইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এস এম ইউসুফ আলী বলেন,
দীর্ঘদিন ধরে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো রাষ্ট্রের সকল নিয়মকানুন মেনে সরকারি বিদ্যালয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ অর্জনে সেই সাথে ধর্মীয় শিক্ষার সমন্বয় করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। অথচ, করোনা মহামারির সময় কিন্ডার গার্টেনসহ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের সকাল অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখলেও উপজেলার প্রতিটি গ্রামে ভেঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা অননুমোদিত নুরানি মাদ্রাসাগুলোর দিকে কোন নজরই দেয়নি সরকার। ফলে অভিভাবকরা গণহারে তাদের সন্তানদের ওইসব মাদ্রাসায় নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেয়। এ সুযোগে একশ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি এখন এক-একটা গ্রামে ১৫/২০টি প্রতিষ্ঠান খুলে নুরানি নামের সঙ্গে এতিমখানা জুড়ে দিয়ে বহুমুখী বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে সরকারি কারিকুলামের কোন বই পড়ানোতো দূরের কথা টাঙানো হয়না জাতীয় পতাকা। গাওয়া হয়না জাতীয় সঙ্গীত। নেই কোন নিয়ম-কানুনের বালাই। চওড়া মূল্যে কিনতে হয় তাদের দেয়া বই। নেয়া হয় মোটা অংকের বেতন। আবার অংক, ইংরেজির জন্য পড়তে হয় প্রাইভেট শিক্ষকের কাছেও। একই সাথে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এবং হাট বাজার থেকে শুরু করে প্রবাসীসহ সকল শ্রেণিপেশার লোকজনের কাছ থেকে এতিমের নাম ভাঙ্গিয়ে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এসব ব্যক্তিরা। এ বিষয়ের সরকারি কোন তদারকি না থাকায় অন্যরাও এদের দেখানো পথে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান খুলতে উৎসাহিত হচ্ছে। এদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেনগুলো শিক্ষার্থী শূন্য হয়ে পড়ছে। তবুও, সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষকরা নিজেদের চাকরি রক্ষার্থে কাগজে কলমে সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অধিক ছাত্র-ছাত্রী দেখিয়ে মাসিক বেতন তুলে নিয়ে এখনও পর্যন্ত টিকে থাকলেও দুই-তৃতীয়াংশ কিন্ডার গার্টেনই বন্ধ হয়ে গেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ সাইনবোর্ড পাল্টিয়ে একই নামে নুরানি মাদ্রাসা ও এতিমখানা খুলে তারাও বাণিজ্য শুরু করে দিয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। বন্ধ হয়ে যাবে অধিকাংশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। সরকার বা শিক্ষা অফিস সে দিকে নজর না দিয়ে আমাদের কিন্ডার গার্টেনগুলোকে হয়রানি করছেন।
একটি বেসরকারি কলেজের প্রভাষক ও কিন্ডার গার্টেন সম্পৃক্ত সাংবাদিক আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা না পারে বাংলা, না পারে ইংরেজি এমনকি তারা আরবিও পারে না। তারা মুখে মুখে কিছু দোয়া কেরাত শিখে। এখানে পড়া লেখা শেষ করে তারা ১২-১৩ বছর বয়সে আবার প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে ক্লাস দু বা থ্রীতে ভর্তি হয়। সেখানেও তারা কিছু পারে না। একসময় তাদের শিক্ষা জীবন শেষ হয়ে যায়। এসকল প্রতিষ্ঠান গুরো সরকার নজরে আনতে হবে। না হলে অচিরেই শিক্ষা ব্যবস্থা ধবংস হয়ে যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রতিটি কিন্ডার গার্টেনের প্রধানরা জানান, করোনাকালে কিন্ডার গার্টেনগুলো পুরোপুরি ধবংসের শেষ পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। এসময় সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কিন্ডার গার্টেনগুলো বন্ধ থাকায় গ্রামের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের এসকল মাদরাসায় ভর্তি করে দেন। কারন করোনা কালীন সময়ও মাদ্রাসাগুলো খোলা ছিল। যে মুহুর্তে কিন্ডার গার্টেনগুলো একটি লড়েচড়ে বসার সময় হয়েছে সে মুহুর্তে দাগনভূঞার শিক্ষা অফিসার কিন্ডার গার্টেনগুলোতে চাহিদার শতভাগ বই না দিয়ে আবার সমস্যায় ফেলছেন। জায়লস্কর ইউনিয়নের সিলোনিয়া বাজারে চিল্ড্রেন গার্ডেনের প্রধান শিক্ষক আলা উদ্দিন জানান, এখন ঘরে ঘরে মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। স্কুল চালিয়ে লোকসানে আছি। তারপরও যদি বই নিয়ে এমন সমস্যা হয় তাহলে অচিরেই কিন্ডার গার্টেনগুলো হারিয়ে যাবে।
দাগনভূঞা কিন্ডার গার্টেন এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইউছুপ মিয়াজী বলেন, এমনিতেই উপজেলার অনেকগুলো কিন্ডার গার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকগুলো বন্ধের পথে রয়েছে। উপজেলার পূর্ব চন্দ্রপুর ইউনিয়নের বৈরাগীর হাট বাজারে অবস্থিত হাশেম মেমোরিয়াল কিন্ডার গার্টেন দীর্ঘ ২৭ বছর সুনামের সহিত পরিচালনা করার পরও স্কুলটির মালিক এ বছর থেকে স্কুল বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিজস্ব স্কুল ভবন হওয়ার পরও গত ৩-৪ বছর লাখ লাখ টাকা লোকসান হওয়ায় স্কুলটি বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। যে সকল ভাড়া ঘরে চালানো হচ্ছে তাদের অবস্থা করুন।
এদিকে দাগনভূঞা উপজেলা থেকে বই নেয়ার সময় প্রতিটি স্কুল থেকে ২০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করে শিক্ষা অফিসের বই বিতরণকারীদের দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। বই বিতরণ করার জন্য কোন বাজেট না থাকায় প্রতি বছর এ নিয়ম প্রযোজ্য বলে জানা যায়।
বিভিন্ন স্কুলের প্রধানদের সাথে কথা বলে জানা যায়, দাগনভূঞা উপজেলার প্রাক প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা শতভাগ বই পেয়েছেন। ৩০-৪০ ভাগ বই পেয়েছেন প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা। দ্বিতীয় শ্রেণির কোন বই দেয়া হয়নি বললেই চলে বই দেয়া হয়েছে ১৫-২০%। তৃতীয় শ্রেণির কোন কোন বিষয় একেবারেই বই দেয়া হয়নি। মোট বই দেয়া হয়েছে ২৫-৩০%। চতুর্থ শ্রেনিতে ৪০-৫০% ও পঞ্চম শ্রেণিতে ২৮-৩০% শিক্ষার্থীর জন্য বই দেয়া হয়েছে। কয়েকটি কিন্ডার গার্টেনের প্রধান বলেন, উপজেলা শিক্ষা অফিসার তাদের বলেছেন, আপনারা ৫০০ টাকা করে বেতন নেন। অনলাইন থেকে প্রিন্ট করে বই পড়ান। সরকারের নির্দশনা অনুযায়ী বই কম দেয়া হচ্ছে। তারা বলেছেন ২৬ বছরের ইতিহাসে এমন ঘটনাটো ঘটেনি। তারা শিক্ষা অফিসারের কাছে যখন জানতে চান অনলাইনে তথ্য আছে, তথ্য অনুযায়ী বই দিবেন না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষা অফিসার তাদের সাথে খারাপ আচরণ করেন বল তারা জানান।
এব্যাপারে জানতে চাইলে দাগনভূঞা উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার ইস্কান্দর নূরী বলেন, বাস্তবে কিন্ডার গার্টেনগুলোতে কতজন শিক্ষার্থী আছে তা এখনও জরিপ করা হয়নি। জরিপ করে বাকী বই গুলো দেয়া হবে। জরিপ কখন করবেন, বছরের শুরুতে সকল শিক্ষার্থীর হাতে কিভাবে বই পৌঁছানো হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি প্রতিবেদককে। বই চাহিদা নিয়ে কেন বই দেয়া হবে না এবং শতভগ বই থাকার পরও কেন দেয়া হবে এমন প্রশ্নের ও উত্তর দেননি তিনি।
ফেনী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নাসির উদ্দিন জানান, ফেনীতে শতভাগ বই এসেছে। কিন্ডার গার্টেন গুলোকে বই না দেয়ার যুক্তিসংগত কোন কারন নেই।