প্রফেসর ড. সুকান্ত ভট্টাচার্য
বাংলাদেশের নির্বাচন মানে এক উৎসব। আর অস্ট্রেলিয়ায় ভোট না দিলে দিতে হয় জরিমানা। এ দেশে নির্বাচনের সময় গ্রামে -গঞ্জে, নগর- জনপদে কত শত জল্পনা-কল্পনা ডানা মেলে ওড়ে! ৭ জানুয়ারি ২০২৪ এ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনী হাওয়া ও প্রবল ভাবে বইতে শুরু করেছে।
এবারে নির্বাচনে বিএনপি তত্ত্ববধায়ক সরকারের দাবিতে এখনো পর্যন্ত নির্বাচনে না এলে ও ৪৪ টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ইতোমধ্যে ৩২ টি রাজনৈতিক দল মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছন। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন ৭১ সংসদ সদস্য । তাদের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৬৩ জন । সাবেক সংসদ সদস্য সহ ৩০ টি আসনে বিএনপি প্রার্থী। দল ও স্বতন্ত্র মিলে মোট প্রার্থী ২৭৪১ জন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি’র ২৯৮ জন স্বতন্ত্র ৪৪২ জন বি এন এম তৃণমূল বিএনপি প্রার্থী ৩১০ জন। সবমিলিয়ে এক জমজমাট নির্বাচনের আভাস পাওয়া গেছে। আর বিএনপি ২৮ অক্টোবরের পর থেকে ৩৭৬ টি বাসে আগুন দিয়েছে। ট্রেনও বাদ যায়নি আগুনের লেলিহান শিখা থেকে।
হায়রে ক্ষমতার মোহ! স্বজন-স্বজাতিকে পেট্রল বোমায় দগ্ধ করে, জ্বালাও-পোড়াও করে নিজ দেশের দ্রুত বিকশিত হওয়া অর্থনীতি ধ্বংস করে ক্ষমতায় গিয়েও কি টিকে থাকা যাবে? একেই কি বলে সভ্যতা?
৭ই জানুয়ারী ২০২৪ বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন এবং নির্ধারিত সময় নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে কমিশন। বিএনপি সহ সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে আহ্বান করে বর্তমান কমিশন নির্বাচনের তফসিল পিছিয়ে দেয়ার ও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু বিএনপি তাদের ভাষায় ‘অবতার’ সদৃশ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের শর্তহীন সংলাপ সহ ইসির আহ্বানে কোন সাড়া দেয়নি।
এ নির্বাচনে ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯২ হাজারের কিছু বেশি ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। এ উপলক্ষে ৩০০ সংসদীয় আসনের ভোটে ৪২ হাজারের ও অধিক ভোট কেন্দ্র প্রস্তুত করছে সিইসি হাবিবুল আওয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশন। ইইউ ও সর্বমহলের প্রত্যাশা ও দাবি- একটি অবাধ সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।
ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা দিয়েছেন এক মাসের অধিক একই স্টেশনে থাকা সব থানার ওসি ও ইউএনকে নিজ কর্মস্থল থেকে অন্যত্র বদলি করা হচ্ছে। অপরদিকে বিএনপি জ্বালাও পোড়াও সহ হরতাল অবরোধ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ সময়ে জীবন – জীবিকা স্থবির থাকে না এখন। করোনা ভাইরাসের সর্বনাসহা অভিঘাত ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে মুদ্রাস্ফীতি সহ বাজার পরিস্থিতি খুবই কঠিন।
প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনা চৌকষভাবে প্রণোদনা প্যাকেজসহ সেফটি নেটওয়ার্ক/নিরাপত্তাবলয় প্রসারিত করে দারিদ্র্য বিধ্বস্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এই সু-কঠিন বৈশ্বিক বাস্তবতার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যথা নিয়মেই এগিয়ে চলেছে। বাস্তবায়িত হচ্ছে মেগা প্রকল্পসমূহ।
পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, উড়াল সড়ক, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কক্সবাজার ঢাকা রেল যোগাযোগ, কমিউনিটি ক্লিনিক, ন্যায্যমূল্যে চাল- ডাল- তেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রি, বিভিন্ন রকম ভাতা ও বিনামূল্যে বইসহ শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ কর্মসূচি বাংলাদেশের জনগণ খুব ভালোভাবে গ্রহণ করেছে।
তাই বিএনপির আন্দোলনে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রতীয়মান হয়নি; হচ্ছেনা। হবে বলেও মনে হয় না। কারণ বর্তমান বদলে যাওয়া বিশ্বে উন্নয়নের গণতন্ত্র গণমানুষের ধ্যান -জ্ঞান, আরাধ্য। সে পথে হেঁটে বঙ্গবন্ধু দেখানো পথে শোষিতের পক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে রূপান্তরিত করেছেন। আজ বাংলাদেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, সুন্দর রাস্তাঘাট, গৃহহীন মানুষ পাকা ঘরে থাকার সুযোগ পেয়েছে।
ধর্মান্ধতার পরিবর্তে ধর্মপরায়ণতা এবং উদার মানবিক অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মানুষকে উদ্ভাসিত করার প্রয়াস পাচ্ছে বর্তমান সরকার। নেই ধর্মীয় হানাহানি। নারীরা আজ স্বাধীনচেতা; ঘরের সব কাজ করেও পোশাক শিল্পে কাজ করছে। সর্বক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে অবদান রাখছে অর্থনীতিতে – তাই তো এত বৈশ্বিক সমস্যার মধ্যেও এ দেশের অর্থনৈতিক চাকা সচল রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন; নন্দিত হচ্ছেন দেশে-বিদেশে।
এ জাতির দুর্ভাগ্য- এদেশের অল্প কিছু কুলাঙ্গার স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা জাতির পিতাকে নিষ্পাপ শিশু সন্তান সহ পৈশাচিকভাবে হত্যা করেছে। পোড়ামাটি থেকে ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠা দেশটাকে পাকিস্তানি ভাবধারায় পিছিয়ে দিতে চেয়েছে। এ ডিসেম্বর মাস ১৯৭১ এ মার্কিন সশস্ত্র নৌবহর এসে ভিড়েছিল বাংলাদেশের বন্দরে এদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামকে নস্যাৎ করে দিতে । সেদিন ততকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে অকুণ্ঠ সাহায্য সহযোগিতা করেছিল।
আমরা তাদের কাছে চিরঋণী। একাত্তরের সে ভূত এখনো আমেরিকার ঘাড় থেকে নামেনি। এখনো ভিসা নীতি, শ্রম অধিকার নীতি ও বিভিন্ন অর্থনৈতিক চাপের ভয় দেখিয়ে সরকারকে নতজানু করার হীন প্রয়াস পাচ্ছে পিটার হাস ও তাদের মিত্ররা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর দর্শন “আমাদের কেউ দাবায় রাখতে পারবে না” হৃদয়ে ধারণ করা বঙ্গবন্ধুর আত্মজা ২০০৪ সালের বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মাথা উঁচু করে রাষ্ট্রপরিচালনা করে বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের অভিধা এনে দিয়েছেন।
২০৪১ সালের মধ্যে এদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত করার প্রাণান্ত প্রয়াস পাচ্ছেন। এ উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করার হীন প্রয়াস পাচ্ছেন পিটার হাসসহ কিছু স্বার্থান্বেষী মহল। রাশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দীর্ঘস্থায়ী রাষ্ট্ররপ্রধানগণ দেশের সার্বিক উন্নয়ন- প্রগতিকে এগিয়ে নিয়েছেন। বাংলাদেশও জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সে পথেই এগিয়ে চলেছে। এটা অনুধাবন করেই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার ষড়যন্ত্রে মেতেছে পিটার হাসসহ কিছু দেশি- বিদেশি ষড়যন্ত্রী। কিন্তু তাদের এই হীন ষড়যন্ত্র সফল হবে না । কারণ এদেশের মানুষ বুকের রক্তে লিখেছে একটি নাম বাংলাদেশ ।
শ্রমে-ঘামে-মেধায় তিলে তিলে গড়েছে এ বদলে যাওয়া বাংলাদেশ । তাকে পিছিয়ে যেতে দেবে না ব-দ্বীপ অঞ্চলের সংগ্রামী মানুষ । স্মর্তব্য , এশিয়া-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বাস্তবায়নে আমেরিকা বাংলাদেশকে পাশে চায়; চায় বঙ্গোপসাগরে ঘাঁটি আর সাগরের গ্যাস উত্তোলনে একচেটিয়া অধিকার৷ তারা চায় না বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ুক৷ বাংলাদেশকে বাগে আনতে আমেরিকা সরকার পরিবর্তনে তাদের হীন চক্রান্ত চরিতার্থ করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
এ কথা সত্য উন্নয়নের বিপুল কর্মবজ্ঞে, পুঁজি গড়ে ওঠার সময়ে দুর্নীতিও পাখা বিস্তার করে। ঘুষখোর, সুদখোর, খেলাপী খণগ্রহীতা, লুটেরার দল, মুনাফালোভী সিন্ডিকেট চক্র, বেগম পাড়া, সেকেন্ড হোম গড়ে তোলা শয়তানেরা, এদেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করার হীন ষড়যন্ত্রে বিভোর ।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনী মেনিফেস্টো ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। যেভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্যাসিনো শয়তানদের শক্ত হাতে শায়েস্তা করেছেন, এবারের নির্বাচনে জয়ী হলে দলমত নির্বিশেষে সব ধরনের দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবেন-এ প্রত্যাশা সকল দেশপ্রেমিক মানুষের ।
জাতির জন্য বঙ্গবন্ধু চৌদ্দ বছর জেলের অন্ধকারে জীবন কাটিয়েছেন, অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করেছেন; বঙ্গমাতা সন্তানসহ বাড়ির আসবাব নিয়ে ঢাকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। এখনও শ্রম সাধক কৃষক-পোশাকশিল্পী, প্রবাসী বাংলাদেশীরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার সংগ্রামে নিমগ্ন । এখনও বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনা মনুষ্যত্ব দিয়ে, দেশপ্রেম দিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা তথা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে একশ বছরের ব-দ্বীপ পরিকল্পনা করেন।
আজকের তারুণ্য ডিজিটাল বাংলাদেশ ও স্মার্ট বাংলাদেশের কনসেপ্ট মনে প্রাণে গ্রহণ করে এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে । স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ । বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে নেতৃতৃ দিচ্ছেন এদেশের প্রধানমন্ত্রী, পাচ্ছেন অসংখ্য আর্তজাতিক স্বীকৃতি,পুরস্কার ।
অতি সম্প্রতি দুবাইয়ের জলবায়ু সম্মিলনে লাভ করেছেন “এশিয়া ক্লাইমেট মোবিলিটি চ্যাম্পিয়ন লিডার এওয়ার্ড” | এ দুর্বার গতিতে ছুটে চলার সময় হরতাল-অবরোধের মত ভোঁতা অস্ত্র সরকার পরিবর্তনে কার্যকর হওয়ার নয়, যদিও প্রতিদিন ছয় হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয় হরতাল-অবরোধের কারনে। কোনো দেশপ্রেমিক মানুষ এ আত্মঘাতি কর্মসূচি সমর্থন করতে পারে না। বেদনার কথা, পুঁজি গড়ে ওঠার সময় ঘটে লুটতরাজ । আশার কথা ,পুঁজি গড়ে উঠলে নিজের স্বার্থেই পুঁজি নিজেকে পাহারা দেয় । আসে সুশাসন,সুন্দর-সুবর্ণ-সুদিন। ক্রমান্বয়ে ধনী- দরিদ্রের বৈষম্যও হ্রাস পায়।
মানবিক হৃদয়ের, বঙ্গবন্ধুর শোণিতধারার গর্বিত, উন্নত-মস্তক উত্তরাধিকার জনমানুষের নেত্রী শেখ হাসিনার কাছেই এ সমৃদ্ধ-মানবিক-অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রত্যাশা-এ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের সিংহভাগ ভোটারের। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশী যেসব ভিনদেশী বেনিয়ার,তাদেরকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে মানুষ।
আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস জয় হবে মানবতার, কারণ “যথা ধর্ম তথা জয় ৷”আর যথা হত্যা, বোমাবাজি, অগ্নিসন্ত্রাস, অর্থনীতি ধ্বংসের নগ্ন চিন্তা, হিংসা, ধর্মান্ধতা তথা পরাভব , গ্লানি, পরাজয় । নষ্টদের দখলে থাকে না সমাজ-পৃথিবী । জেগে ওঠে শ্রমঘন প্রান্তিক জনতা । এই বিজয়ের মাসে দেশ প্রেমিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত সব মানুষের প্রতীতিঃ
জয় হবে, জয় হবে,হবে জয়
মানবের তরে মাটির পৃথিবী-দানবের তরে নয়।
লেখক: চেয়ারম্যান, ইংরেজি বিভাগ ও সিনেট সদস্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।