নিজস্ব প্রতিবেদক
আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে সংলাপে বসতে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু চিঠি দিয়েছেন বলে সোমবার (১৩ নভেম্বর) দেশীয় গণমাধ্যম বেশ সরগরম ছিল। এর আগের দিন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস প্রধান এ তিনদলের নেতাদের মধ্যে শর্তহীন বৈঠকের আহ্বান জানান। বিএনপির গত ২৮ অক্টোবর সহিংস সমাবেশের পর পিটার হাস শর্তহীন আলোচনার আহ্বান জানালেন।
ডোনাল্ড লুর চিঠি পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এবং জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক। তবে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়–য়া বলেছেন, তারা লুর কাছ থেকে এমন চিঠি পাননি।
আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টি আগে থেকেই আলোচনার জন্য উন্মুক্ত ছিল কিন্তু পুরো উল্টো ছিল বিএনপি। তারা ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বৈঠক করতে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। তবে গত দুই সপ্তাহে সহিংসতা, পুলিশ কর্মীকে পিটিয়ে হত্যা এবং আওয়ামী লীগ কর্মীর নিহতের ঘটনার পর ক্ষমতাসীনরা তাদের অবস্থান পাল্টিয়েছে। তারা এখন বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় যেতে অনেকটা আগ্রহী না।
এমন আলোচনার প্রস্তাব দেওয়া নিসন্দেহে ভালো উদ্যোগ কিন্তু অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক এই সময়ে আলোচনা ও পিটার হাসের এমন উদ্যোগ নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেছেন। কেননা ২৮ অক্টোবর সমাবেশের আগে বিএনপির নেতৃত্বের সঙ্গে পিটার হাস অনেকটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছিলেন। তিনি তখন এমন রাজনৈতিক আলোচনার কোনো প্রস্তাব দেননি। কিন্তু বিএনপির সহিংসতার পরেই যেন পিটার হাসের উদ্যোগ পালটে গেল।
বিএনপির সহিংস রাজনীতির সঙ্গে আওয়ামী লীগের অতীত অভিজ্ঞতা, বিশেষ করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক জিয়ার ক্রিমিনাল রেকর্ড এবং সন্ত্রাসবাদ সম্পর্ক, ক্রমবর্ধমান এমন সন্দেহের জন্য পরীক্ষা করা দরকার। তারেক জিয়াকে বাংলাদেশের বিতর্কিত একজন ব্যক্তি হিসেবেই বলা চলে।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তার মা খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে তারেক জিয়া একপ্রকার ছায়া সরকার হিসেবে কাজ করেছেন। তবে পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাস ও ষড়যন্ত্র থেকে শুরু করে একাধিক মামলায় তাকে কারাদ- দেওয়া হয়েছে।
২০০৪ সালের আগস্টে ঢাকায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পার্টি অফিসের সামনে এক সমাবেশে প্রাণঘাতী গ্রেনেড হামলা হয়। ওই হামলায় প্রাণ হারান ২৪ জন এবং আহত হয়েছেন ৩০০ জনের বেশি। সেই হামলায় শেখ হাসিনা প্রাণে বাঁচলেও তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে সেই হামলায় শেখ হাসিনার দেহরক্ষী মাহবুবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের তৎকালীন নারী বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানের প্রাণহানি ঘটে। হামলায় গুরুতর আহত হওয়ার তিনদিন পরে মারা যান আইভি রহমান।
এই প্রাণঘাতী মামলায় ১৯ জন দোষী সাব্যস্ত হন। যার মধ্যে তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়। ২০০০ দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার পরিমাণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। বিশেষ করে হারকাতুল জিহাদ (হুজি) মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। ২০১১ সালে হুজির নেতা মুফতি হান্নান স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাতে তিনি স্বীকার করেন, তারেক রহমান গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনায় সরাসরি জড়িত ছিলেন।
ওই জবানবন্দি অনুসারে, মুফতি হান্নান জানান ওই গ্রেনেড হামলার উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্মূল করা। যার মধ্যে শেখ হাসিনাও ছিলেন। মুফতি হান্নান দাবি করেন, তারেক রহমানসহ জামায়াতের নেতা আলি আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর সরকারি সহায়তার কথা নিশ্চিত করেছিলেন।
২০১১ সালে ডেইলি স্টারে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়, হান্নান বলেছেন হাওয়া ভবনে (তারেকের অফিস) বৈঠকে গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা হয়। ওইসব বৈঠকে বিএনপির তৎকালীন কয়েক জন মন্ত্রী, বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ী উপস্থিত ছিলেন। যদিও বিএনপির সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য নেতারা এসবকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন কিন্তু একজন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত ব্যক্তির এসব স্বীকারোক্তি উপেক্ষা করা কঠিন।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, গত ১৫ বছরে কী এমন হলো যে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এবং মার্কিন দূতাবাস তাদের সুর বদলালো। তারা এমন একটি দলের সঙ্গে সংলাপে বসার জন্য তোরজোড় করছে, যেই দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন একজন গুরুতর রাজনৈতিক দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি। অথবা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই কেনই বা নৈতিকভাবে বাধ্য হবেন এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে সংলাপে বসতে যিনি তাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েছেন? যেখানে আওয়ামী সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, সেখানে বিএনপি আবার সহিংসতার পথ বেছে নিয়েছে।