মাজহারুল হক রাশেদ
একটি জাতির প্রজন্মকে সুস্থ ও সুশৃংখলভাবে গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন জাতির নিজস্ব বিবর্তন ও বিকাশের ইতিহাসে তার অতীত ঐতিহ্যের অন্বেষণ। সঠিকভাবে অতীতকে উপস্থাপনের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের মধ্যে স্বদেশ-স্বজাতির প্রতি মমত্ববোধ সৃষ্টি হয়, স্বদেশপ্রেম জাগ্রত হয়। অপরপক্ষে ইতিহাসের বিকৃতি বা অবমূল্যায়ন একটি জাতির মেরুদ-কে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়, যার পরিণতি একটি জাতির জীবনে মারাত্মক বিপর্যয়কর হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের দেশের উজ্জ্বল ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস এখনও পর্যন্ত মারাত্মক বিকৃতির শিকার। ফলে বিভ্রান্ত প্রজন্ম সৃষ্টি হচ্ছেÑ বাঙালীর সংস্কৃতি, আত্মপরিচয় তার সুমহান সংগ্রাম আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। এমতাবস্থায় বিবেকের তাড়নায় সচেতন মানুষ তাড়িত হচ্ছেÑ এ তাড়না থেকে আমার কলম ধরাÑ এটি সীমাবদ্ধ থাকবে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তি হতে শুরু করে আমাদের সুমহান স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত সময়সীমার মধ্যে এবং এটি মূলতঃ সীমাবদ্ধ থাকবে এই সময়কার রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের অনুসরণের ভেতর। ইতিহাসের প্রকৃত সত্য অনুুসন্ধানের প্রচেষ্টায় তথ্যবহুল উপস্থাপনা আমার লক্ষ্য।
যেহেতু পাকিস্তানের জন্ম থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাসের সময়টুকুর ইতিহাসের সত্য ধারণ করবার প্রয়াস আমারÑ তাই এই ২৩ বছর (১৯৪৭-১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ)Ñ এ ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক উত্থান-পতনের চিত্র পরিষ্কারভাবে উপস্থাপনার প্রয়োজন। এক্ষণে একথা বলতে চাই যে, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ বেনিয়া ১৯০ বছরের সুদীর্ঘ শোষণের পর দ্বি-জাতি তত্ত্ব (প্রকৃত অর্থে একে দ্বি-ধর্ম তত্ত্ব বলে অভিহিত করা সমীচীন। কেননা উভয় দেশের মধ্যে অর্থাৎ ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বহুজাতির বসবাস এবং এ জাতিসমূহ সংখ্যানুপাতে বেশ কয়েকটি প্রায় কাছাকাছিÑ কিন্তু ধর্মানুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ও মুসলমান) এর উপর ভিত্তি করে অদ্ভুত রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্মÑ যার পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মাঝে অন্য একটি রাষ্ট্রের (ভারত) অবস্থান ও দূরত্ব ১২০০ মাইল এবং দু’অংশে সম্পূর্ণ ভিন্ন চিন্তা, চেতনা, সংস্কৃতির মানুষের (জাতি) বাস। পাকিস্তানের জন্মের পরপরই পূর্ব ও পশ্চিম অংশ আলাদাভাবে বিবেচিত হতে থাকে শাসকগোষ্ঠির নিকট। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠি তাদের স্বার্থের পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য যে চক্রান্তে লিপ্ত হয়Ñ সে চক্রান্তের প্রথম অংশে ছিল পূর্বাংশের (পূর্ববঙ্গের তথা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের) সাংস্কৃতিক জাগরণকে স্তব্ধ করে দেবার চেষ্টাÑ এর প্রমাণ মেলে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ৪ মাসের মাথায় ১৯৪৭ এর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন রাজধানী করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুকে গ্রহণের সুপারিশ করবার মাধ্যমে। ৬ ডিসেম্বর এই সংবাদ ঢাকার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাঙালি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা হিসেবে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানায়। পাকিস্তান গঠনের ৪ মাসের মাথায় ভাষা নিয়ে চক্রান্তের ফলে দু’অংশের মধ্যে রোপিত হয় রাজনৈতিক বিভেদের বীজÑ যার জন্যে দায়ী এককভাবে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠি।
এক্ষণে আরেকটু সামনে এগোনো যাক। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’ এর উত্তরসূরী ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগ’ এর কাঠামো ভেঙ্গে একদল তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বেরিয়ে আসেন এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগ’ গঠন করেন। ছাত্রলীগ পঞ্চাশ দশক থেকে শুরু করে স্বাধীনতার সময়কালীন পর্যন্ত (যেহেতু এটিই আমার আলোচনার কালÑ তাই এর পরবর্তী সময় ধর্তব্য নয়) এতদ্ঞ্চলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীকে পরিণত হয়। অগ্রসর বাঙালির রাজনৈতিক চেতনায় পরিবর্তন আনতে ছাত্রলীগের জাতীয়তাবোধ, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে অমূল্য অবদান রাখে।
১৯৪৮ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশনে যখন ইংরেজি ও উর্দূকে কথা বলার ভাষা হিসেবে নির্বাচিত করা হয় তখন ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও রাজকুমার চক্রবর্তী ইংরেজি ও উর্দূ এর পাশাপাশি বাংলাকেও গণ-পরিষদের ভাষা হিসেবে ব্যবহারের প্রস্তাব করেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং অন্যান্য পশ্চিমা নেতারা এর তীব্র বিরোধিতা করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় ২৭ ফেব্রুয়ারি একটি ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এ পরিষদ ১১ মার্চ তারিখে পূর্ব বাংলায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও ধর্মঘট পালন করে।
১১ মার্চ হরতালের সময় ঢাকার আব্দুল গণি রোড দিয়ে একটা বিক্ষুব্ধ ছাত্রমিছিল এগিয়ে যাচ্ছিলÑ নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মিছিল সচিবালয়ের সামনে আসতেই ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ। আকষ্মিকভাবে সবাই দেখতে পেলেন শেখ মুজিব আর পূর্ববঙ্গের তৎকালীন আই.জি. শামসুদ্দোহা (৪২-এর আন্দোলনের সময়কার মেদেনিপুরের কুখ্যাত পুলিশ অফিসার দোহা) রাস্তার উপর রীতিমত কুস্তি ও ধস্তাধস্তিতে লিপ্ত হয়েছেন। পুলিশ বহু কষ্টে দুজনকে আলাদা করে দোহাকে পাঠায় হাসপাতালে, শেখ মুজিবকে কারাগারে। পাকিস্তানে এটাই হচ্ছে শেখ মুজিবের প্রথম কারাবরণ। তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের বয়স মাত্র ৭ মাস। পরবর্তী সাড়ে ২৩ বছর সময়কালে অর্থাৎ অখ- পাকিস্তানের শেষদিন পর্যন্ত শেখ মুজিবের কারাজীবন হচ্ছে ১৩ বছর ৯ মাস। উপরন্তু রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে দু’বার ফাঁসির আসামী।
১৯৪৮ সালে পূর্ববঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন উর্দূভাষী এবং ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা নাজিম উদ্দীন। ছাত্র আন্দোলনের প্রচ- চাপে ১৬ মার্চ তিনি সকল ছাত্রনেতাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হনÑ ঐ দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ছাত্র-সভায় সভাপতিত্ব করলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ সভায় পুলিশি হামলা হলে – ১৭ মার্চ ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভায় পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন উর্দূ হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষাÑ ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও তিনি একই ঘোষণার পূনরোল্লেখ করেনÑ ছাত্র সমাজ তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
মুসলীমলীগের অগণতান্ত্রিক আচরণ এবং পূর্ব বাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে বাঙালি জাতীয়তাবাদে আস্থাশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা মিলিত হয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক গোপন বৈঠকে সৃষ্টি করেন ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিমলীগ’। এ দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা ভাষানী এবং সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক। কারাগার বন্দী অবস্থায়ও এ দলের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিবর রহমান।
আবার একটু পিছিয়ে যাইÑ ১৯৪৮ এর মার্চের শেষ সপ্তাহে জিন্নাহ ফিরে গেলেন পশ্চিম পাকিস্তানে তার জন্যে তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে। এর মাত্র দেড় মাসের মধ্যে শুরু হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্তুথ শ্রেণির কর্মচারীদের ধর্মঘট। বেতন বৃদ্ধি ও চাকুরির নিরাপত্তার জন্যে আন্দোলনরত এ কর্মচারীদের পক্ষ নেন শেখ মুজিবসহ ২৭ জন ছাত্রনেতা। এদের মধ্যে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। ২৭ জনকেই বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রদান করার পর ক্ষমা চাইতে বলল। ২৬ জন ক্ষমা প্রার্থনা করলেও শেখ মুজিব ক্ষমা চাইলেন না। এর জন্যে ১৯৪৯ সালে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি তখন বলেনÑ আমি যদি এ দেশের সন্তান হয়ে থাকি তবে এ বহিষ্কারাদেশ যতদিন বহাল থাকবে ততদিন আমি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পদার্পণ করব না। ১৯৭২ সালে তাঁর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার ও তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন সদস্য করা হয়। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিশেষ অধিবেশনে যোগদান করেন।
১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে আওয়ামী লীগ এর নেতৃত্বে একটি ভূখা মিছিল বের করা হল। মূখ্যমন্ত্রী নাজিম উদ্দীনের বাসভবন ঘেরাও করা ছিল এ মিছিলের লক্ষ্য। পুলিশ মিছিল থেকে মাওলানা ভাষানী, শামসুল হক এবং শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে। এর অল্প কিছুদিন পর ভাষানী এবং শামসুল হক মুক্তি পেলেও শেখ মুজিবকে দীর্ঘদিন কারাগারে থাকতে হয়।
এক্ষণে ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত সময়টাতে আসি। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন উর্দূই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে বলে ঘোষণা করার প্রেক্ষিতে ৩০ জানুয়ারি ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ ৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট, শোভাযাত্রা এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব বাংলায় বিক্ষোভ মিছিল ও সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। সে সময়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাজবন্দীদের মধ্যে দু’জন ছিলেন শেখ মুজিবর রহমান ও বৃহত্তর বরিশালের মহিউদ্দীন আহমদ (সদ্য প্রয়াত)। [অন্য রাজবন্দীরা ছিল কমিউনিষ্ট পার্টিসহ বামপন্থী দলসমূহের নেতৃবৃন্দÑ তারা ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন সমর্থন করেননিÑ যা পরবর্তীতে তাদের পার্টির মূল্যায়নেই ছিল ভুল সিদ্ধান্ত ও পার্টির গণবিচ্ছিন্নতার প্রমাণ] তারা দু’জনে জেলে উন্নতমানের খাওয়া ও সম্মানজনক ব্যবহারের দাবিতে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে। অনশন আরও বিস্তৃতি লাভ করতে পারেÑ এ আশংকায় জেল কর্তৃপক্ষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মহিউদ্দীন আহমদকে জেল হসপিটালে ও শেখ মুজিবকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হসপিটালে স্থানান্তর করেন। এখানেই ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতাদের সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা হয়। ১৮ ফেব্রুয়ারি গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে তাঁকে ফরিদপুর জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ৫২’ এর ২১ ফেব্রুয়ারি – সে ইতিহাস সকলেরই জানা।
১৯৫২ এর ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব মুক্তি পান। এ সময় দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়লে শেখ মুজিব অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। এতে মোশতাক ক্ষুব্ধ হয়Ñ মূলত মুজিব-মোশতাক বিরোধের সূচনা হয় এখান থেকেই।
এক্ষণে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের উল্লেখ করছিÑ
১৯৫৩’র ৯ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিমলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমান পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৪ ডিসেম্বর ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়।
১৯৫৪’র ১০ মার্চ প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে ২২৭টি আসনে মুসলিমলীগ পরাজিত হয়। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রী সভার কনিষ্ঠতম মন্ত্রী হিসেবে ১৫ মে শেখ মুজিব শপথ গ্রহণ করেন। ৩০ মে কেন্দ্রের নির্দেশে পূর্ববঙ্গের মন্ত্রীসভা বাতিল ঘোষণা করা হয়। কমিউনিষ্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয় এবং শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ ৭ মাস পর ২৩ ডিসেম্বর তিনি মুক্তি লাভ করেন।
১৯৫৫ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটিতে সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় পূর্ববাংলাকে স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে অন্যথায় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ থেকে সকল সদস্য পদত্যাগ করবে। ২১ অক্টোবর ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়।
১৯৫৬ সালে শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের সক্রিয় সমর্থনে কেন্দ্রীয় গণপরিষদে গণবিরোধী সংবিধান পাশ হয়। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এর ১৩ জন সদস্য এতে স্বাক্ষর দানে অস্বীকৃতি জানায়। কেননা এ সংবিধানে ‘এক মাথা এক ভোট’ নীতি বাতিল করে সংখ্যা সাম্য নীতি প্রবর্তন ও পূর্ববঙ্গের নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করা হয়। এ সময় ব্যাপক আন্দোলনের মুখে কেন্দ্রে ও প্রদেশে মন্ত্রীসভার ভাঙ্গাগড়া চলতে থাকে। অবশেষে কেন্দ্রে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। শেখ মুজিব এতে শিল্পমন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন।
১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ও বামপন্থী মতাদর্শের মধ্যে তীব্র বিরোধের মুখে আওয়ামী লীগ হাইজ্যাক করার অপচেষ্টা রুখবার জন্য আকষ্মিকভাবে শেখ মুজিব মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করেন। তখন আওয়ামী লীগ এর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কোন মন্ত্রী দলে কোন নেতৃস্থানীয় পদে থাকতে পারবেন না। মুজিব মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করায় চরম বামপন্থীরা দল হাইজ্যাকের সুযোগ না পেয়ে ভাষানীকে সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করে। এরপর ২৬ জুলাই ঢাকার ‘রূপ মহল’ সিনেমা হলে নতুন রাজনৈতিক দল ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ (ন্যাপ) গঠিত হয় – সভাপতি হন মাওলানা ভাষানী।
১৯৫৮ সালে মাত্র ৬ দিনে তিনটি মন্ত্রীসভার পতনের পর ২৩ জুন বিরোধী দল পুনরায় বাজেট অধিবেশনে হট্টগোল সৃষ্টি করে ও আওয়ামী লীগ পন্থী ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলীকে আক্রমণ করে। এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন ও পরদিন মারা যান। ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সারাদেশে সামরিক আইন জারী করে সংবিধান বাতিল, রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবসহ বহু সংখ্যক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়। এর মাত্র ২০ দিন পর বন্দুকের মুখে সেনাপতি আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন।
১৯৫৯ সালে ১৪ মাস পর কারাগার থেকে শেখ মুজিব মুক্ত হলেও জেল গেট থেকে তাঁকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে হাইকোর্টে রীট আবেদন করা হলে তিনি মুক্তিলাভ করেন।
১৯৬০ সালে সামরিক আইনের বিরুদ্ধে প্রথম ছাত্রবিক্ষোভ সংগঠিত হয়।
১৯৬১ সালে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৬২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জননিরাপত্তা আইনে শেখ মুজিবকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়। এ বছর ২ জুন ৪ বছর ব্যাপি সামরিক শাসনের অবসানের পর ১৮ জুন শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। ৫ জুলাই পল্টনের জনসভায় শেখ মুজিব বলেনÑ “আইয়ুব খান প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্র (পরোক্ষ নির্বাচন) পদ্ধতি হচ্ছে পূর্ববঙ্গের স্বার্থবিরোধী।” আইয়ুব খানের শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ঢাকায় প্রচন্ড ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। ২৪ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিব লাহোর গমন করেন এবং বিরোধী দলীয় মোর্চা ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টে’ যোগদান করেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে।
১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুুজিব দলবলসহ ‘নিষ্ক্রিয়’ ‘জাতীয় ণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ ত্যাগ করেন।
১৯৬৪ সালের ২৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করা হয়। পার্টির নতুন সভাপতি মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশ এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিব। এ সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে শেখ মুজিবের উদ্যোগে দাঙ্গা বিরোধী কার্যক্রম শুরু করা হয়। ঐতিহাসিক “পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও” শীর্ষক দাঙ্গা বিরোধী প্রচার পত্র বিলি করা হয়।
১৯৬৫ সালে আপত্তিকর বক্তব্য দেওয়ার অপরাধে শেখ মুজিবকে এক বছরের কারাদ- দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টের নির্দেশে তিনি মুক্তিলাভ করেন। এ বছরে পাক-ভারত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সময়ে পূর্ববঙ্গ সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় থাকে।
১৯৬৬ সালে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় তাসখন্দে যুদ্ধ-বিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সরকার বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে শেখ মুজিব ঐতিহাসিক ‘৬-দফা’ প্রস্তাব পেশ করেন। প্রায় ১১ বছর আগে আওয়ামী লীগ পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্ত্বশাসনের জন্য যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল ‘৬-দফা’ ছিল তারই উচ্চতর রূপ। সম্মেলনে সকল বিরোধী দল ‘৬-দফার’ তীব্র বিরোধিতা করলে শেখ মুজিব সম্মেলন বর্জন করেন। ঢাকায় গিয়ে তিনি বলেনÑ ‘৬-দফা’ বাঙালির মুক্তির সনদ। জবাবে আইয়ুব খান বলেনÑ ‘অস্ত্রের ভাষায় এর জবাব দেওয়া হবে।’।
১ মার্চ আওয়ামীলীগ এর সম্মেলনে (১৯৬৬) শেখ মুজিব সভাপতি ও তাজউদ্দীন আহম্মদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন দুজনে মিলে নতুন লড়াই শুরু হল। এ সময় শেখ মুজিব ‘৬-দফার’ পক্ষে জনমত গঠনের জন্য ব্যাপক সফর শুরু করেন। এ সময় তাঁকে ঢাকা, ময়মনসিংহ, যশোর, খুলনা ও সিলেটে বার বার গ্রেফতার করা হয়। ৮ মে নারায়ণগঞ্জ শ্রমিক সমাবেশ থেকে ফেরার পর নবম বারের মত তাকে গ্রেফতার করে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে ৭ জুন সমস্ত পূর্ব বাংলায় হরতাল পালিত হয়। এর পরপরই দৈনিক ইত্তেফাক বন্ধ, সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার ও নিউ নেশন প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়।
১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকারের এক প্রেস নোটে বলা হয়Ñ পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে সশস্ত্র বাহিনীর মোট ২৮ জন বাঙালি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এদিকে ২০ মাস কারাগারে আটক থাকার পর ১৮ জানুয়ারি রাত সাড়ে তিনটায় (অস্বাভাবিক সময়) মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং পূর্ব পরিকল্পনা মত জেল গেট থেকে মুজিবকে সামরিক বাহিনীর হেফাজতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ১১ এপ্রিল ইসলামাবাদ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত এক প্রেস নোটে বলা হয়Ñ দেশ রক্ষা আইনে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তিনি তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নং বিবাদী (আসামী)। এ মামলায় মোট ৩৫ জনকে আসামী করা হয়।
১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানী সমাপ্ত হয় এবং এ বছরের শুরু থেকেই পূর্ববঙ্গে আইয়ুব বিরোধী বিক্ষোভ দানা বাঁধে। সেনাবাহিনী দফায় দফায় গুলিবর্ষণ করে। শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা এ সময়ে তুঙ্গ স্পর্শ করে। ২০ জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয় ও ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে শোভাযাত্রা বের হয়। জনৈক পুলিশ অফিসার এদিন ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানকে গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
২৬ থেকে ৩১ জানুয়ারি পূর্ব-পশ্চিম সর্বত্রই আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন বিস্তৃতি লাভ করে। পরিস্থিতি দ্রুত অবনতি হতে থাকলে ১ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট কর্তৃক রাওয়ালপি-িতে ‘গোল টেবিল’ বৈঠক আহ্বান ও ইত্তেফাকের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।
এ সময় আন্দোলন গ্রামীণ পর্যায়েও বিস্তৃতি পেতে থাকেÑ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে (১৫ ফেব্রুয়ারি) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টর শামসুজ্জোহাকে (১৮ ফেব্রুয়ারি) গুলি করে হত্যা করা হলে পরিস্থিতি ভয়ংকর আকার ধারণ করে ও প্রশাসন স্থবির হয়ে পড়ে।
১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি ‘রাজনৈতিক লবী’ শেখ মুজিবের নিকট প্যারোলে মুক্তি নিয়ে গোল টেবিল বৈঠকে যোগ দিতে অনুরোধ করলে তিনি বলেনÑ তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও মামলার সমস্ত আসামীর মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত পি-িতে যাওয়া সম্ভব নয়। ঢাকার রাস্তায় তখন শ্লোগান ‘জয় বাংলা’,‘ জেলের তালা ভাংবো, শেখ মুজিবকে আনবো’। এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স বাতিল করেন। মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসে শেখ মুজিবসহ অন্যান্যরা।
২৩ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে গণ-সংবর্ধনায় তৎকালীন ডাকসু ভিপি তোফায়েল আহমদ জনগণের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন। এ গণ-সংবর্ধনায় প্রায় দশ লক্ষ লোক সমাবেত হয়েছিলেন।
১০ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পি-িতে গোল টেবিল বৈঠকে বসলেন। অন্যান্য বিরোধী দলগুলো (ভাষানী-ভূট্টো) তাঁকে আইয়ুবের দালাল বলে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা চালালো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ৬-দফা দাবির প্রশ্নে অনঢ় থাকায় বৈঠক ভেস্তে যায়Ñ ২৪ মার্চ ’৬৯ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন। এর সমস্ত কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। অবশ্য এ সময়ে পুনরায় সামরিক শাসন জারি করেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং তিনি ’৭০ এ সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
১৯৭০ সালে রাজনৈতিক কর্মকা-ের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করা হয়। শেখ মুজিব সভাপতি এবং তাজউদ্দীন সাধারণ সম্পাদক হন। ৭ জুন রেসকোর্স থেকে ‘৬-দফা’ কে নিয়ে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারাভিযান শুরু করেন। ১২ নভেম্বর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলীয় এলাকায় ধ্বংসস্তূপ সৃষ্টি হলেও পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী থাকে নির্বিকার। বঙ্গবন্ধু এর প্রতিবাদ জানান এবং যথাসময়ে নির্বাচনে অংশ নেবার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। ৭ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ জাতীয় পরিষদের পূর্ববঙ্গের ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ টি আসনে জয়ী হয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা (জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ মিলে ৩১৩টি আসন) লাভ করে।
১৯৭১ এর শুরুই হয় পশ্চিমা ষড়যন্ত্র দিয়ে। নির্বাচনী রায় বানচাল করার জন্য ভুট্টো-ইয়াহিয়া জোট পাকাতে লাগলেন। অবশ্য এর কারণও ছিল। এক্ষণে ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়ার গোয়েন্দাদের কর্তৃক রেকর্ডকৃত টেপের কিছু অংশ, মুজিব বলেনÑ “আমার লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এল.এল.ও (লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার) টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলব। নির্বাচন শেষ হওয়ার পর আমাকে চ্যালেঞ্জ করবে কে?” ইয়াহিয়া এ টেপ শুনে বলেনÑ “সে যদি বিশ^াসঘাতকতা করে তাহলে আমি তাকে দেখে নেব।” [নিয়াজির আত্মসমর্পণের দলিলÑ সিদ্দিক সালিক, পৃষ্ঠা-১৭]
’৭১ এর ৩ জানুয়ারি নবনির্বাচিত আওয়ামীলীগ সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে শপথ নেন তা শুরু হয় ‘আমার সোনার বাংলা- আমি তোমায় ভালবাসি’ গান দিয়ে এবং শেষ হয় ‘আমার দেশ- তোমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘জাগো জাগো- বাঙালি জাগো’। [দৈনিক পাকিস্তান, ৪ জানুয়ারি] এ সময় ভুট্টো-ইয়াহিয়া মিলিতভাবে বাঙালিদের ক্ষমতার আহরণের পথ বন্ধ করে দেবার চক্রান্তের ফসল হিসেবে ১ মার্চ ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করল। এর প্রতিবাদে ২ ও ৩ মার্চ হরতাল পালিত হয়। বঙ্গবন্ধু ১ মার্চ থেকে ডাক দেন অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারকে সম্পূর্ণরূপে অকেজো করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জারি হল ৩৫ টি নীতিমালা। জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনে এ ৩৫ টি নীতিমালার ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গ চলতে লাগলÑ
এল ৭ মার্চÑ রেসকোর্স-এ বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করলেন, “——- প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে —— রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, তবু এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইন্শাআল্লাহ। ——- এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”
ঢাকাসহ সমস্ত প্রদেশব্যাপি সেনাবাহিনী-জনতা সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। ১৬ মার্চ ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে বঙ্গবন্ধু-ইয়াহিয়া আন্দোলন শুরু হয়। এক পর্যায়ে ভুট্টোও এসে হাজির হন। এ সময় ২৩ মার্চ প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর নিজ বাসভবনে নিজ হাতে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজ পতাকা উড়িয়ে দেন। এই ঘটনার মাধ্যমে ২৩ বছরের পাকিস্তানি শাসনের বেড়ি ভেঙে ৭ কোটি বাঙালির মুক্তির ঘোষণা আনুষ্ঠানিকতা লাভ করে। ২৫ মার্চ বিকেলে চোরের মত পালিয়ে যায় ভুট্টো, সন্ধ্যায় পালায় ইয়াহিয়া। যাওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া স্বাক্ষর করে যান ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক গণহত্যার দলিলে। রাত ১১ না বাজতেই শুরু হলো গণহত্যা।
সিদ্দিক সালিক তার ‘উইটনেস টু সারে-ার’ গ্রন্থে লিখেছেনÑ “ডযবহ ঃযব ভরৎংঃ ংযড়ঃ যধফ নববহ ভরৎবফ, ‘ঃযব াড়রপব ড়ভ ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ পধসব ভধরহঃষু ঃযৎড়ঁময ড়হ ধ ধিাবষবহমঃয পষড়ংব ঃড় ঃযধঃ ড়ভ ঃযব ড়ভভরপরধষ চধশরংঃধহ জধফরড়. ওহ যিধঃ সঁংঃ যধাব নববহ, ধহফ ংড়ঁহফবফ ষরশব, ধ ঢ়ৎব-ৎবপড়ৎফবফ সবংংধমব, ঃযব ঝযবরশয ঢ়ৎড়পষধরসবফ ঊধংঃ চধশরংঃধহ ঃড় নব ঃযব ‘চবড়ঢ়ষব’ং জবঢ়ঁনষরপ ড়ভ ইধহমষধফবংয.’ ওঃ ংধরফ, ‘ঞযরং সধু নব সু ষধংঃ সবংংধমব. ঋৎড়স ঃড়ফধু ইধহমষধফবংয রং রহফবঢ়বহফবহঃ. ও পধষষ ঁঢ়ড়হ ঃযব ঢ়বড়ঢ়ষব ড়ভ ইধহমষধফবংয, যিবৎবাবৎ ুড়ঁ ধৎব ধহফ রিঃয যিধঃবাবৎ ুড়ঁ যধাব, ঃড় ৎবংরংঃ ঃযব ধৎসু ড়ভ ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ ঃড় ঃযব ষধংঃ. ণড়ঁৎ ভরমযঃ সঁংঃ মড় ড়হ ঁহঃরষ ঃযব ষধংঃ ংড়ষফরবৎ ড়ভ ঃযব চধশরংঃধহ ড়পপঁঢ়ধঃরড়হ ধৎসু রং বীঢ়বষষবফ ভৎড়স ঃযব ংড়রষ ড়ভ ইধহমষধফবংয ধহফ ভরহধষ ারপঃড়ৎু রং ধপযরবাবফ.'” (‘উইটনেস টু সারে-ার, পৃষ্ঠা-৭৫)
ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ডকুমেন্টস’Ñ এ ওই ঘোষণার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল। ঘোষণাটির বাংলা অনুবাদ- “এই-ই হয়তো আপনাদের জন্যে আমার শেষ বাণী হতে পারে। আজকে থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি যে যেখানেই থাকুন, যে অবস্থাতেই থাকুন এবং যার হাতে যা আছে তাই-ই নিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলুন। ততদিন পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যানÑ যতদিন না দখলদার পাকিস্তান বাহিনীর শেষ সৈনিকটি বাংলাদেশের মাটি থেকে বহিষ্কৃত হচ্ছে এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হচ্ছে।”
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার এই ঘোষণাটি ঢাকার সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিস চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ এর তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জনাব এম.এ. হান্নানের নিকট প্রেরণ করে। যখন বাণীটি চট্টগ্রামে পৌঁছায় তখন ক্যালে-ারে ২৬ মার্চ শুরু হয়ে গেছে। এ জন্যেই আমাদের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চে পালন করা হয়।
স্বাধীনতার ঘোষণাটি ২৬ মার্চ দুপুর হতে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বার বার প্রচারিত হতে থাকে। জনাব এম.এ. হান্নান নিজে প্রথমে ঘোষণাটি পাঠ করেন । পরবর্তীতে ২৭ মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমানকে বেতারে নিয়ে এসে নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করানো হয়।
এটির মূল ইংরেজি (প্রথমাংশ) ছিল নিম্নরূপÑ
“ও গধলড়ৎ তরধ, ড়হ নবযধষভ ড়ভ ড়ঁৎ মৎবধঃ ষবধফবৎ ঃযব ঝঁঢ়ৎবসব ঈড়সসধহফবৎ ড়ভ ইধহমষধফবংয ঝযবরশয গঁলরনঁৎ জধযসধহ, ফড় যবৎবনু চৎড়পষধরস ওহফবঢ়বহফবহপব ড়ভ ইধহমষধফবংয.” বাণীর সমাপ্তিতে ছিলÑ
“গধু অষষধয যবষঢ় ঁং. ঔড়ু ইধহমষধফবংয.”
এরপর ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত হল নির্বাসিত গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে, তাই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। এই প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় মুক্তিযুদ্ধ, যার সর্বাধিনায়ক ছিলেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধু।
১৯৪৮ সালে ভাষার প্রশ্নে যে সংগ্রাম শুরু হয় তার চূড়ান্ত পরিণতি পায় ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির মাধ্যমে। আর এর প্রতিটি পর্যায়ের নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। সংগ্রামের প্রথমার্ধে সম্মিলিতভাবে এবং পরবর্তীতে এককভাবে সংগ্রাম পরিচালনা ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে নেতৃত্ব তাঁর।
বাংলাভাষাÑ বাঙালি জাতিÑ বাংলাদেশ এক সূত্রে গাঁথা মালা। এই মালায় পরিশিলিতভাবে প্রতিটি ফুল গাঁথতে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। এর প্রতিটি পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শÑ তাঁর প্রদর্শিত পথÑ আর এ জন্যেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্থপতিÑ এ জন্যেই তিনি বাঙালি জাতির পিতা। শত্রুরা যত বিভ্রান্তির সৃষ্টি করুক না কেনÑ ইতিহাসের আমোঘ বিধানে এ সত্যের মৃত্যু নেই। ‘জয় বাংলা’
গ্রন্থ সূত্র:
১. নিয়াজীর আত্ম-সমর্পণের দলিল- সিদ্দিক সালিক (ভাষান্তর: মাসুদুল হক)
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার ইতিহাস- মোহাম্মদ হান্নান।
৩. লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে- মেজর রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তর)
৪. বাংলাদেশের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস- মোনায়েম সরকার।
৫. বঙ্গবন্ধু- এম. আর. আক্তার মুকুল।
৬. বঙ্গবন্ধুÑ কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়- আব্দুল মতিন।
লেখক: এডভোকেট, অধ্যক্ষ ফেনী ল কলেজ।