জি.এম. তাজউদ্দিন
ধরুন আপনি নিঃসঙ্গ অবস্থায়। কেউ একজন আপনার সাথে অন্তরঙ্গ কথা বলছে। আপনার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে , আপনার পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করছে ,আপনার কাঙ্খিত রচনাটি লিখে দিচ্ছে কিংবা আপনাকে বিজনেস প্ল্যান বা বাড়ির নকশা করে দিচ্ছে । আপনার এ সহযোগী যদি মানুষ না হয়ে মেশিন হয় কেমন লাগবে? হ্যাঁ আমরা সে সময় চলে এসেছি।
ভারতের উডিষ্যায় এ আই এংকর লিসা এবং বাংলাদেশের এই এ আই এংকর অপরাজিতা মানুষের মাঝে এ.আই ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছে। এ.আই নিয়ে মানুষের উত্তেজনা ও আশংকা সমানভাবে লক্ষণীয়। মূল বিষয়ে আসা যাক।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিইয়াল ইন্টেলিজেন্স ( এ,আই) হল মেশিন বা কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত রোবটের ক্ষমতা, যা বুদ্ধিমত্তার সাথে সম্পর্কিত কাজগুলো সম্পাদন করতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন যন্ত্রকে কিছু শেখানোর মাধ্যম হচ্ছে আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক (এ এন এন)। মাত্র কয়েক বছরে এ.আই কল্পনা থেকে বাস্তবে পরিণত হয়েছে । যে মেশিনগুলো মানুষকে বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সাহায্য করে তা শুধু সাইফাই মুভিতে নয় বাস্তব জগতেও রয়েছে। কিছু বছর আগেও যা গল্প ছিল আজ তা বাস্তব। আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এই আই প্রযুক্তি ব্যবহার করছি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে এবং কোথাও না কোথাও এটি আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
সিরি- এলেক্সা থেকে চ্যাটবট পর্যন্ত প্রত্যেকেই তাদের দৈনন্দিন রুটিনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বহন করছে। চ্যাটজিপিটি তো এখন বাচ্চাদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। এ আই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি। চিকিৎসা বিজ্ঞানে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে এ.আই। এ.আই খুবই দক্ষতার সাথে ক্যান্সার কোষ শনাক্ত করতে পারে। এছাড়াও মেডিকেল ইমেজিং, রেডিওগ্রাফি, েেমমোগ্রাফি, নিউক্লিয়ার মেডিসিন, সার্জারি, ব্রাকি থেরাপি, তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ বসানো প্রভৃতি ক্ষেত্রে এ.আই বিপ্লব এনেছে। পৃথিবীর অনেক জায়গায় এখন স্বয়ংক্রিয় চালকবিহীন স্মার্ট কার চলছে। স্যাটেলাইট নেভিগেশন, জিপিএস, গুগল আর্থ, গুগল ম্যাপ, গুগল এসিস্টেন্ট, গুগল সার্চ ইঞ্জিন এগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তারই প্রয়োগ। আশা করা হচ্ছে, ২০৩০ সালে স্বচালিত ড্রোন এর বাজার হবে ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যবহারে এ.আই এর সাফল্য ঈর্ষনীয়। মাইক্রোসফট, অ্যামাজন, টেসলা ও আলিবাবার মত বড় বড় প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু সময় ধরে এ.আই ব্যবহার করছে। বিশ্ব অর্থনীতি এখন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে। প্রতিদিন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার লেনদেন হচ্ছে । শুধু কিপ্টোকারেন্সি নয়, আগামীর বিশ্ব অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে চলে যাবে এ.আই এর হাতে। মেশিন লার্নিং (এম,এল) রোবোটিক্স প্রযুক্তি মানুষের জীবন যাপন ও অভিজ্ঞতাকে পাল্টে দিচ্ছে। ফলে মানব ইতিহাসে এক নতুন সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। ১৯৯৬ সালে আইবিএম এর ডিপ বুলু কম্পিউটার তখনকার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দাবাড়– কাসপারভ কে হারিয়ে বিশ্বকে চমক দেখানোর কথা এখনো অনেকের মনে আছে। কাতার বিশ্বকাপে অফসাইড শনাক্ত করতে এআই প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া হয়েছে। ১৯৯৬ সাল থেকে প্রতিবছর রোবাকোপ ( রোবট সকার ওয়ার্ল্ড কাপ) টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
২০২০ সালে গার্ডিয়ান পত্রিকা একটি প্রবন্ধ লিখেছিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন রোবট জিপিটি থ্রি । বিজ্ঞানীদের অনুমান ২০৪৯ সালের মধ্যে রোবটের লেখা বই বেস্ট সেলার এর জায়গা দখল করবে। ইতিমধ্যে জাপানে বুদ্ধিমান মেশিন রচিত ছোট উপন্যাস সাহিত্য পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়েছে। আগামিতে স্মার্ট আইওটি (ইন্টারনেট অব থিংগস) এর সমন্বয়ে মানুষের জীবনযাত্রা হবে অকল্পনীয় প্রযুক্তি নির্ভর।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশ্ববাসীর মনে এক অজানা আশংকার জন্ম দিচ্ছে। এ প্রযুক্তি একদিন মানুষের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যাবে। মানুষকে হত্যা করবে। যুদ্ধক্ষেত্রের স্বয়ংক্রিয় রোবট অনেক মানুষের মুত্যুর কারণ হবে। আগামীতে রোবট মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ব্যক্তির সম্মান, শ্রদ্ধাবোধ হ্রাস পাবে, তৈরি হবে এক যান্ত্রিক সমাজ কাঠামো। মানুষের কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে, অনেক পেশাই বিলুপ্ত হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অকেযো যন্ত্রাংশ পরিবেশের বিপর্য় ডেকে আনবে। চালক বিহীন গাড়ি শুধু গন্তব্যে দ্রুত পৌঁছালে হবে না সেটি মানুষের মৃত্যুর কারণ না হয় সেটিও মাথয় রাখতে হবে। প্রযুক্তির এ বিপ্লব বিশ্বকে ভারসাম্যহীন করে দিবে। ইলেন মার্কস এ.আই উন্নয়নকে ‘দৈত্য কে ডেকে আনার শামিল’ বলে উল্লেখ করে, এটি মানবজাতির জন্য আণবিক বোমার চেয়েও বিপদজনক বলে অভিহিত করেছেন। নিকট ভবিষ্যতে মানুষের ব্যক্তিগত প্রাইভেসি বলতে কিছু থাকবে না। মার্কিন নির্বাচনে এআই এর ব্যবহার আগামীর রাজনীতিতে তাদের দাপটের বার্তা দিচ্ছে। এমতাবস্থায়, নিরাপদ মনে না করে কোন এ.আই বাজারে ছাড়া প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উচিত হবে না। এমন কিছু করা যাবেনা যা নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়ে। প্রযুক্তির ব্যবহারকে যেমনই বাদ দেওয়ার সুযোগ নেই, একইভাবে তা যাতে মানব সভ্যতার বিপক্ষে না যায় সেজন্য এখনই সচেতন হওয়া আবশ্যক।
লেখক: ইনস্ট্রাক্টর, ফেনী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট