জমির বেগ
ফেনীর পরশুরাম উপজেলা কমপ্লেক্সের মিলয়ায়তনের নির্মাণ কাজের পাইলিং ‘ফি কাস্টিং’ পদ্ধতিতে করায় এর প্রচন্ড শব্দে আশপাশ এলাকায় প্রচন্ড ঝাঁকুনি ও বিকট শব্দের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে কর্মস্থলটির প্রায় এক বর্গ কিলোমিটার এলাকায় কম্পিত (প্রকম্পিত) হওয়ার ঘটনা ঘটছে। চিকিৎসকসহ স্থানীয়রা জানান, এরকম বিকট শব্দের কারনে এখানকার বাসীন্দাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে। রয়েছে হার্ট এ্যাটাকসহ নানা রোগে আক্রান্তের সম্ভাবনাও।
পরশুরামে উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনের নির্মাণ কাজ গত ১১ জুন রোববার থেকে শুরু হয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান হাইড্রলিক মেশিন ব্যবহার না করে হেমার ব্যবহার করে ‘ফি কাস্টিং’ পদ্ধতিতে এখানে পাইলিং এর কাজ করছেন। পাইলিংএ তারা ব্যবহার করছে অনেক বড় ডিজেল মেশিন ও ৫ হাজার কেজি ওজনের হেমার। এতে উপজেলা কমপ্লেক্সে থাকা সরকারি বিভিন্ন অফিস ভবন, পাশের ডায়াবেটিস হাসপাতাল ছাড়াও আশপাশের অর্ধশতাধিক ভবন মালিক ও বসবাসকারীরা ঝুকিপুর্ণ অবস্থায় রয়েছেন। পাইলিং এর বিকট শব্দে একদিকে সরকারি অফিসে কাজ কর্ম যেমন বন্ধের উপক্রম, তেমনি আশপাশের ভবনে বাসিন্দাদের বসবাস অনুপোযোগি হয়ে উঠেছে। হেমারিং এর মাধ্যমে পাইলিং এর কারনে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ভবনে ফাটল ও পলেস্তরা খসে পড়ায় উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী মো. আরাফাত ভূঞা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা প্রকৌশলী বরারবর ‘ফি কাস্টিং’ পদ্ধতিতে পাইলিং এর কাজ বন্ধ করতে লিখিত ভাবে আবেদন করেছেন।
এদিকে চিকিৎসকরা জানান, এভাবে বিকট শব্দ জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিকর। হার্টের রোগীদের বড় ধরণের দুর্ঘটনার ঝুঁকি ছাড়াও রয়েছে শিশু ও বৃদ্ধরা স্থায়ীভাবে কানে না শোনারও সম্ভাবনা রয়েছে। ।
শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. শরিয়ত উল্যাহ মজুমদার বলেন, শিশুদের ঘুম খুবই প্রয়োজন। বিকট শব্দের কারণে শিশুদের ঘুম ভেঙ্গে গেলে তারা খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাবে। এতে শিশুরা মানসিক ও শারীরিক সকল ধরণের সমস্যায় পরবেন। পরবর্তীতে এটি জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা, সহকারী অধ্যাপক, (কার্ডিওলজি) ডা. মো. আজিজুল করিম শামীম বলেন, বিভিন্ন কারনে যেসকল শব্দ দূষন হয় সেটা গাড়ির হতে পারে বিল্ডিং কনস্টাকশনের পাইলিংএর কারনে হতে পারে বা বিভিন্ন কারনে হতে পারে এ শব্দ দূষণ গুলো মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। যেমন অনেকের শ্রবণশক্তির সমস্যা হতে পারে। শ্রবণশক্তি হ্রাস হতে পারে। হৃদরোগের রোগীদের হার্টের সমস্যা হতে পারে। তাদের উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে ও হার্টের রোগ জটিল আকার ধারণ করতে পারে। এ উচ্চ রক্তচাপটা নিয়ন্ত্রণের বাহিরেও যেতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ থেকে শ্বাসকষ্ট হার্টে ব্যথা এমনকি ইমারজেন্সিও হয়ে যেতে পারে।
নোয়াখালী আবদুল মালেক উকিল মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শহীদ উল্লাহ দিদার বলেন, শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল থাকার কথা। কিন্তু এসকল যন্ত্রপাতি ১৫০ থেকে ২৫০ ডেসিবেল শব্দ তৈরী করছে। এটা আসলে শব্দ সন্ত্রাস। শব্দ সন্ত্রাসের কারনে শ্রবণশক্তি হ্রাস, অবসাদ, উচ্চ রক্তচাপ, স্মরণশক্তি হ্রাস, দুশ্চিন্তা, উগ্রতায় আক্রান্তের সম্ভাবনা রয়েছে।
অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ যোবায়ের হোসায়েন নিয়মতি এভাবে আওয়াজ হলে, যেখানে আমাদের ইনার ইয়ার যেখানে শ্রবনযন্ত্র আছে তা স্থায়ীভাবে অকেজ হয়ে যায়। ইনার ইয়ারের মধ্যে দুটি পার্ট থাকে। ৯০ ডেসিমেলের উপরে আওয়াজ হলে ইনার ইয়ার পারমানেন্ট ডেমেজ হয়ে যাবে। দেখা যাবে তারা কানে কম শুনবে ও কানের মধ্যে শো-শো আওয়াজ হবে। মানুষের কান যেকোন শব্দ শোনার জন্য যথেষ্ট সংবেদনশীল। অতিরিক্ত আওয়াজ কানের পর্দাকে বেশ জোরে ধাক্কা দেয়। যা কানের পর্দারও ক্ষতি করতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে এর প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে। শৈশবে বিভিন্ন ধরণের শব্দের কারণে বৃদ্ধ বয়সে কানের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়।
বিভিন্ন টাওয়ার নির্মানকারী প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলীর জানান, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবেল হলেও, এই মেশিন সৃষ্টি করছে ১৫০ থেকে ২৫০ ডেসিবেল। পুরোনো পদ্ধতিতে পাইলিংয়ের এই কর্মযজ্ঞের কারনে পুরো এলাকা থরথর করে কম্পন হওয়ায় আশপাশের এক কিলোমিটারের মধ্যে সবগুলি বিল্ডিং এর ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। আধা কিলোমিটারের মধ্যে বেশীর ভাগ বিল্ডিং এর ফাটলও দেখা দিতে পারে। ‘ফি কাস্টিং পাইলিং’ সাধারণত করা হয়ে থাকে যেসব জমিতে মাটির ভারবহন ক্ষমতা কম কিন্তু সেখানে বহুতলভিত্তিক ভবন নির্মাণ করা হবে সেখানে। পাইলিং কয়েক ধরনের হতে পারে। যেমন- কাস্ট-ইন-সিটু পাইল, স্যান্ড পাইল, প্রি-কাস্ট পাইল, শোর পাইল, টিম্বার পাইল। প্রি-কাস্ট পাইলের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ পাইল আগে কাস্টিং বা ঢালাই করা হয়। এরপর এটি হাইড্রোলিক মেশিনের সাহায্যে ভূমিতে যথাস্থানে ঢোকানো হয়।
এদিকে বিকট শব্দ করে ফাইলিং করায় পরশুরামের উপজেলা কমপ্লেক্স এলাকায় বসবাসরতা জানান, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান খরচ বাঁচাতে ব্যাপক শব্দদূষণ করছে। এর মূল্য আমরা কেন দেবো? তারা জানান, তারা বাসায় থাকতে পারছেন না। হেমারিং এর আঘাতে তাদের বিল্ডিং থরথর করে কাঁপছে। অনেক ভবনের জানালার গ্লাস ও বিভিন্ন তাকে থাকা কাঁচের জিনিসপত্র পরে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। পরশুরাম উপজেলা যুবলীগ সভাপতি ইয়াসিন শরীফ মজুমদার বলেন, তারা বাসায় থাকতে পারছে না। ইতোমধ্যে বাসার ফাটল ধরেছে, পলেস্তারও খসে পড়েছে। গতকাল শনিবার ভোর কাজ শুরু করলে তার শরীর অসুস্থ হয়ে পরে। ভোর ৬টায় গিয়ে তিনি শ্রমিকদের বাধ্য করেন কাজও বন্ধ করতে।
পরশুরাম বনিক সমতিরি সাংগঠনিক সম্পাদক পরশুরাম উপজেলা কম্পাউন্ডের ব্যবসায়ী মো. ইকবাল বাবুল বলেন, হেমারিংএর কাঁপুনিতে তাঁর দোকানের মোবাইল বেশ কয়েকদিক তাক থেকে পড়ে গেছে। টিভি কাঁপে, বিল্ডিং কাঁপে ও তিনি কাঁপেন। তাঁরা ব্যবসায়ীক ভাবে ও শারীরিকভাবে খুবই অসুবিধা ভোগ করছেন। তিনি এমনিতেই হার্টের রোগী। নিয়মিত হার্টের ঔষধ খান। তিনটি রিং বসানো। এ শব্দের কারেন আমার খুব সমস্যা হচ্ছে। যারা তাঁর থেকে আরো বেশি হার্টের সমস্যায় আছেন তাদের যে কোন মুহুর্তে যেকোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। মাঝ বয়োসি এক মহিলা নাম প্রকাশ করার শর্তে বলেন, এমন আওয়াজ হতে থাকলে যে কোন মুহুর্তে বয়রা হয়ে যাবো। এখানে কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে কানে সারাক্ষন শো-শো শব্দ করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারি এক কর্মকর্তা বলেন, এটা খুবই অমানবিক ব্যাপার। তারা আমাদের অধিকার হরণ করতে পারে না। তারা বাড়ি বানাবেন, বানাক। কিন্তু এভাবে শব্দ দূষন করে অন্যের অধিকার, আমার অধিকার ক্ষুন্ন করার অধিকার তাদের রাষ্ট্র দেয়নি। এটা একমাত্র আমাদের দেশ বলেই সম্ভব! পরশুরাম প্রেসক্লাবের সভাপতি আবু ইউসুফ মিন্টু বলেন, এটা একটা ভয়ংঙ্কর পরিস্থিতি। এ পাইলিংটা যখন করা হয় তখন আশপাশের বিল্ডিং থরথর করে কাঁপে। একটি টেবিলের উপর কম্পিউটারসহ অন্য কোন জিনিস রাখা যায় না এতা বিকট শব্দ হয়। এতে যেমন শব্দ দূষন হচ্ছে মেনি আশপাশের সব বিল্ডিং ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। স্কুল ছাত্র হৃদয় বলেন, বিকট আওয়াজে তাদের খুব ভয় লাগে, পড়া-লেখা করতে পারে না। স্কুল ছাত্র ইউসুফ বলেন, শব্দের কারনে তাদের পড়া লেখায় মন বসে না। তারা দাদু অসুস্থ, তিনি প্রায় সারাক্ষন শুয়ে থাকেন। এখন দিনে ঘুমাতেই পারে না। তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে শব্দের কারনে।
পরশুরাম উপজেলা প্রকৌশলী এস. এম শাহ আলম ভূঁঞা বলেন, শব্দের কারনে সমস্যাতো একটু হচ্ছে এটা সত্য। শব্দ দূষনতো হচ্ছে এটা মেনে নিতে হবে। আশেপাশে শব্দ দূষণ হচ্ছে কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। হেড কোয়াটার থেকে এভাবেই ডিজাইন করা হয়েছে।
উপজেলা চত্বরে ডায়াবেটিস হাসপাতালের ডাক্তার ও রোগী, কৃষি কর্মকর্তা, সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও পরশুরাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দা শমসাদ বেগম হেমারিং এর বিকট শব্দে সরকারি
সব দপ্তরের ভবন কেঁপে উঠার কথা স্বীকার করলেও নিজেরা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় এব্যাপারে কোন বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
পরশুরাম উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন মজুমদার বলেন, উপজেলায় ভবন হচ্ছে এটা আমাদের জন্য খুশির খবর। বর্তমান আধুনিকযুগে যে ফাইলিং এর মাধ্যমে এর কাজ হচ্ছে এ ফাইলিং আমরা আর দেখি নাই। এর মধ্যে ফেনী সদর, ছাগলনাইয়া, ফুলগাজীতেও আধুনিক যুগের ফাইলিং হয়েছে। কিন্তু এ ফাইলিং এর কারনে এলাকার আশেপাশে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। ব্যাপারটা পরশুরাম উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির সমন্বয়সভায় আলোচনা হয়েছে। অনেক বাড়ি ঘরে ক্ষতি হচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কয়েকদিন কাজ বন্ধ রেখেছিলো। এটা মানুষ চায় না। শব্দ দূষণ থেকে মানুষের বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যাপারটি প্রশাসনের হওয়ায় আমার কিছু করার নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শব্দ দূষণ এক ধরনের মারাতœক পরিবেশ দূষণ। আমাদের সঠিক ধারণার অভাবে এ দূষণের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে। অনেক পরিবেশবিদ বাংলাদেশের শব্দ দূষণের বর্তমান পযায়কে ‘শব্দ সন্ত্রাস’ বলে অভিহিত করেছেন। বিশ্বের বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান প্রায় সবসময় প্রথম বা দ্বিতীয় থাকে। এর অন্যতম প্রধান কারণ শব্দ দূষণ।
শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা (২০০৬) অনুসারে, দিন ও রাত ভেদে পাঁচটি অঞ্চলে শব্দের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেমন নিরিবিলি এলাকা, আবাসিক এলাকা, বাণিজ্যিক এলাকা, শিল্প এলাকা ও মিশ্র এলাকা।
প্রসঙ্গত; একতলা বিশিষ্ট এ ভবনে প্রায় ৭০টি পিলার ও পাশের ভবন নির্মাণে আরো ১৮৪টি পিলার পাইলিং করার কথা রয়েছে। এতে প্রায় তিন মাস সময় লাগতে পারে। উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে একতলা বিশিষ্ট মিলনায়তন ও উপজেলা পরিষদ ভবন নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে সাত কোটি টাকা। প্রকল্পটির নির্মাণ কাজ পান মেসার্স এ্যারও স্পিড। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্তাধিকারী কফিল উদ্দিন মিনার।
আধুনিক প্রযুক্তির এই যুগে শব্দ দূষণমুক্ত পাইলিং হাইড্রলিক মেশিনের মাধ্যমে কাজ করার নিয়ম রয়েছে। জানা যায়, ভবন নির্মাণের আধুনিক হাইড্রলিক মেশিনে পাইলিং করার জন্য প্রতি বর্গফুটে খরচ হয় ৬০০ টাকা। আর শ্যালো মেশিন ও ডিজেলচালিত ইঞ্জিন দিয়ে পাইলিংয়ে খরচ হয় ৯০-১০০ টাকা। সাড়ে সাত কোটি টাকা বরদ্ধে ভবন নির্মাণে হেমার দিয়ে পাইলিং এ চুক্তিবদ্ধ হয়েছে প্রতি ফুট ৯০ টাকা দরে।